দৃক নিউজ২৪, ঢাকা:- দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে পুনঃ তপশিলের সুযোগ নেই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ফলে শেষ পর্যন্ত বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্ধারিত আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল। ঐদিন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর পক্ষ থেকে কোনো আসনেই মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হয়নি। যদিও নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩০টি ভোটে আসার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ইসিকে জানিয়েছে। আর ১৪টি দল ভোটে যাচ্ছে না। এখনো অনানুষ্ঠানিক হিসাব অনুযায়ী সারা দেশের ৩০০ সংসদীয় আসনে ২ হাজার ৭৪১ জন প্রার্থী এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। তবে কোন দলের কতজন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যা কত তা এখনো প্রকাশ করতে পারেনি ইসি।
মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় শেষ হয়েছে। এরপর যদি বিএনপি ও তাদের সমমনারা নির্বাচনে আসতে চান, সেক্ষেত্রে তাদের জন্য আর কোনো সুযোগ রয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেছেন, ঘোষিত তপশিল অনুযায়ী ৩০ নভেম্বর বিকাল ৪টায় মনোনয়নপত্র দাখিলের সময় শেষ হয়েছে। বিধায়, নির্বাচন কমিশন মনে করে, এই সময়সীমা বৃদ্ধি করার আর কোনো সুযোগ নেই। তাহলে কি বিএনপিকে ছাড়াই ভোট হচ্ছে, এমন প্রশ্নে ইসি সচিব বলেন, এটা আপনারা বুঝে নেন।
বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিক্ষোভ ও অবরোধ, হরতাল কর্মসূচি পালন করছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলও সংবিধান অনুযায়ী ইসির ঘোষিত তপশিল অনুযায়ী ভোটের বিষয়ে অনমনীয় মনোভাবে রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে পুনঃ তপশিল ঘোষণা করবে না ইসি। ফলে বিএনপিকে ছাড়াই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এবারের সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বৃহস্পতিবার পুলিশের আইজি, জননিরাপত্তা বিভাগ ও জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিব নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেন।
পুনঃ তপশিল না করার ব্যাখ্যায় ইসি বলেন, ইতিমধ্যে মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে আপনাদের অবহিত করা হচ্ছে যে, এ সময়সীমা বর্ধিত করার সময় বা সুযোগ নেই। অর্থাত্ কোনো সময় বাড়ছে না।
কতগুলো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, এমন প্রশ্নে ইসি বলেন, বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত বাংলাদেশের ৩০০টি আসনে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের কাছে সম্মানিত পদপ্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। আমরা রাতে জানতে পারব, কোন আসনে কোন রাজনৈতিক দলের কোন কোন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তারপর আসলে আমরা বলতে পারব, কতগুলো রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। এর আগে সত্যিকার অর্থে বলা সম্ভব নয়। আমরা শুক্রবার এটা সংগ্রহ করে আপনাদের বলতে পারব।
পুলিশের আইজিপি, দুই সচিবের সঙ্গে সিইসির বৈঠকের বিষয়ে তিনি বলেন, সকালে পুলিশ প্রধান (আইজিপি), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং বিকালে সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কমিশনের সঙ্গে সক্ষাত্ করেছিলেন। তারা তাদের নিজ নিজ দপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সম্পর্কে কমিশনকে অবহিত করেছেন। বিশেষ করে আইজিপি ও জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা দিয়েছেন এবং আইজিপি আপনাদেরও অবহিত করেছেন। নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ রয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে কমিশনকে জানিয়েছেন।
ইসিসচিব বলেন, আর বিকালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব প্রশাসনিক কোনো বিষয়ে কোনো নির্দেশনা রয়েছে কি না, তা নিয়ে কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। কমিশন তার বক্তব্য শুনেছেন এবং সে বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। সেভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করবেন।
চার মন্ত্রী ও সাকিবসহ ২১ জনকে ইসির শোকজ :নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের কাছে মনোনয়ন ফরম জমা দিতে গিয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘনের হিড়িক পড়েছে। নির্বাচনি আচরণবিধির তোয়াক্কা না করে মিছিল, শোডাউন ও মোটর শোভাযাত্রাসহ মনোনয়ন ফরম জমা দেন প্রার্থীরা। এসব প্রার্থীদের অনেককে শোকজ (কারণ দর্শানো) করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এছাড়া মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার আগে সংবর্ধনা ও সাংবাদিক লাঞ্ছনা ও হুমকিমূলক বক্তব্যের জন্য শোকজ করা হয়েছে কয়েক জনকে।
ইসি সূত্র জানায়, সরকারের চার মন্ত্রীসহ ২১ জনকে বিভিন্ন অভিযোগে শোকজ (কারণ দর্শানো) করেছে ইসি। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও রয়েছেন। এ বিষয়ে শুক্রবারের মধ্যেই তাদেরকে জবাব দিতে বলেছে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের জন্য গঠিত নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। শোকজের গ্রহণযোগ্য জবাব না দিতে পারলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করেছে কমিটি। তিন মন্ত্রীসহ যাদের শোকজ করা হয় তারা হলেন—নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, গাজীপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও ঢাকা-১৯ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, নাটোর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য ও নরসিংদী-৫ (রায়পুরা আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, গাজীপুর-৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, মাগুরা-১ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী (ক্রিকেটার) সাকিব আল হাসান, জাতীয় পার্টি-জাপার প্রেসিডিয়াম সংসদ সদস্য ও ঢাকা-৬ আসনে দলের প্রার্থী কাজী ফিরোজ রশীদ, চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী, লক্ষ্মীপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ার হোসেন খান, লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর-সদর আংশিক) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন ও লক্ষ্মীপুর-৩ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী গোলাম ফারুক পিংকু, সুনামগঞ্জ-৪ আসনে জাতীয় পাটি-জাপা মনোনীত প্রার্থী পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ, পটুয়াখালী-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহিব্বুর রহমান, রংপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তুষার কান্তি মন্ডল, মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাস ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, নাটোর-২ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শফিকুল ইসলাম শিমুল ও ময়মনসিংহ-১১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজিম উদ্দীন আহম্মেদ ধনু। এছাড়া নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি আহসানুল ইসলাম রিমনকেও উসকানিমূলক বক্তব্যের জন্য শোকজ করা হয়।
প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে ইসি সচিব বলেন, কিছু কিছু জায়গায় আপনারা দেখেছেন, পদপ্রার্থীরা যাদের কার্যক্রমে মনে হয়েছে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে; সেক্ষেত্রে আমাদের নির্বাচনি অনুসন্ধানী যে কমিটিগুলো রয়েছে, তারা অনেককে ব্যাখ্যা তলব করেছেন। তারা সেখানে তাদের কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন। এ ছাড়া রিটার্নিং কর্মকর্তাদের মাধ্যমে আমাদের আচরণবিধি নিশ্চিত করার দায়িত্বে নিয়োজিত যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা, তারাও কাজ করছেন। তারা যেসব ক্ষেত্রে মনে করছে, আচরণবিধি লঙ্ঘন হচ্ছে; তারা তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন।
‘স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস’ উদ্যাপনে ইসির আপত্তি :দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস উদ্যাপনে আপত্তি জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আগামী ১২ ডিসেম্বর ‘স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস উদ্যাপন হলে প্রার্থীদের নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে মনে করছে ইসি। তাই এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিবকে চিঠি পাঠিয়েছে ইসি। গতকাল ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপসচিব মো. আতিয়ার রহমান স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত চিঠি থেকে এ তথ্য জানা যায়। চিঠিতে বলা হয়, আগামী ১২ ডিসেম্বর জেলা ও উপজেলা/থানা পর্যায়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ দিবস ২০২৩ উদযাপন করা হবে। সেখানে সংসদ সদস্য/মন্ত্রী অন্যান্য দলীয় নেতারাসহ অনেকে উপস্থিত থাকতে পারেন এবং যেখানে রাজনৈতিক বা দলীয় প্রচারণা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যার ফলে সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘন হতে পারে। ফলে নির্বাচনের আগে এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশন অসম্মতি জ্ঞাপন করছে। এ অবস্থায় উল্লিখিত সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল তপশিল ঘোষণা করেন। সে অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ছিল মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। ১ থেকে ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই সম্পন্ন হবে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর। প্রার্থীরা ৬ থেকে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে রিটার্নিং অফিসারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। ১৮ ডিসেম্বর প্রার্থীদের মধ্যে নির্বাচনি প্রতীক বরাদ্দ। ৭ জানুয়ারি সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এবার সব আসের ভোট হবে ব্যালট বাক্সে। এই নির্বাচনে সারা দেশে ৪২ হাজার ১০৩টি ভোটকেন্দ্রের অধীনে ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।
More News Of This Category