স্বতঃস্ফূর্ততা, বিশুদ্ধতা, সত্য, মিথ্যা, দুঃখ, সুখ, বাস্তবতা ধরনের শব্দগুলো সম্পূর্ণ আপেক্ষিক। অর্থাৎ ব্যক্তিভেদে বা ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গির অবস্থানগত পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের শব্দের অর্থ বদলে যায়
আমাদের ব্যবহার্য সব শব্দ ও বাক্যই ব্যক্তি কেন্দ্রিক। অর্থাৎ ওই শব্দ বা বাক্যকে ঘিরে সেই ব্যক্তির অতীত অভিজ্ঞতা (যা কি না ব্যক্তিভেদে আলাদা হতে বাধ্য) সেই ব্যক্তির হৃদয়ে যে অনুরণন তৈরি করে, ওই শব্দ বা বাক্যের তাত্পর্য সেই ব্যক্তির কাছে ততটুকুই। যে কারণে একই শব্দ বা বাক্য একজনের কাছে হাস্যকর মনে হলেও আরেকজনের কাছে সেটা বিশাল গুরুত্ব বহন করে। মোটা দাগে বুঝিয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, একজনের বুলি অন্যজনের গালি।
যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমান রাজনীতি বেশি আবর্তিত হচ্ছে, পদ-পদবিকে ঘিরে। পদ-পদবি ছাড়াও যে কারো মধ্যে নিজস্ব রাজনৈতিক ভাবনা থাকতে পারে—সেটা কেউ মেনে নিতে চায় না। রাজনীতির জন্য কী করছে বা ভাবছে তার চেয়ে বড় কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যক্তি। অবশ্যই রাজনৈতিক ভাবনা মানেই সমষ্টিগত মানুষের জন্য সংগঠিত কিছু মানুষের সমন্বিত ভাবনা। যেটাকে আমরা আদর্শিক ভাবনা বলে থাকি।
সেই ভাবনা অবশ্যই জীবনের সূক্ষ্ম রংগুলোকে খুঁজে বের করে, হৃৎস্পন্দনের কম্পনকে হাজার তারের সুর-ঝংকার সৃষ্টি করে। ক্ষণিকের জন্য একটি অতিনাটকীয় রোমাঞ্চকর পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টায় নিয়োজিত হওয়া নয়, সেই ভাবনাকে সংগঠিত করে। ধাবিত করা উচিত রাজনীতির গভীরতম অঞ্চলে প্রবেশ করার ভাবনায়। দেশের মানুষের জীবনযাত্রা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে ভেতরগতভাবে রূপান্তরিত হচ্ছে, সেটা অনুধাবন করে, তার মৌলিক পরিবর্তনের চেষ্টায় নিজেদের ভাবনাগুলোকে অনবরত পরিবর্ধন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করে পরিশুদ্ধতা আনয়নের চেষ্টাই পারে রাজনীতিকে গতিশীল ও সমসাময়িক করা। পুরনো কোনো আদর্শ বুকে লালন করা আর মৌলবাদের সঙ্গে পার্থক্য খুব কম। এর অন্য পিঠে আছে চুপচাপ বসে সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকা, যার অপর নাম সুবিধাবাদী রাজনীতি।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট যদি ভাবি, যে মানুষগুলো ভাষা আন্দোলনে ছিলেন, তাঁরা কি সবাই শেষ পর্যন্ত সেক্যুলারিজমের পক্ষে বা বাংলার মানুষের মুক্তির পক্ষে থাকতে পেরেছিলেন? এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের কেউ কি মৌলবাদী রাজনীতির সঙ্গে যোগ দেননি? ইতালির মুসোলিনি বাম ঘরানার রাজনীতির ধারক-বাহক ছিলেন, সেই একই ব্যক্তি কিভাবে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রবক্তা হন এবং মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে বিরোধী পক্ষ তো বটেই, এমনকি নিজের দলের নেতাদেরই জেল-জুলুম, হত্যা-গুম করে, সেই সময়ের ইতালীয় রাজনীতির শক্তিশালী অংশ বাম ঘরানার পথ পরিহার করাকে অপরিহার্য মনে করেন, সেটা মনে অনেক প্রশ্ন জাগায়। এখানে সমস্যা দাঁড় করিয়েছিল নেতৃত্বের কিছু সেন্সলেস অংশ। এই পার্টি আর পাঁচ বছর আগের পার্টি যে এক নয় বা পার্টির আল্টিমেট গোল বা প্ল্যান কী হতে যাচ্ছে সেটার বিষয়ে নিশ্চিত না হতে পেরে, পার্টির সুপ্রিম অথরিটির সঙ্গে পার্টির থিংক ট্যাংকের বিচ্ছিন্নতা এ অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। যে কারণে বহু কনফিউজড নেতা পার্টি লাইনের সঙ্গে একাত্ম কি না সেটাই বুঝতে পারেননি এবং সেই বিবর্তনে তাঁদের ভূমিকা কী হতে পারে সে বিষয়ে সেই কনফিউজড নেতারা নিশ্চিত ছিলেন না। সলিউশন হিসেবে যে অপশনগুলো তাঁদের সামনে খোলা ছিল তা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক যোগাযোগ। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের কে কতটুকু পার্টির সুপ্রিম অথরিটির আল্টিমেট প্ল্যানের সঙ্গে যুক্ত আছেন, আর কে কে বিরাগভাজন হয়েছেন সেটা তাঁরা তো দূরের কথা, এক মুসোলিনি ছাড়া অন্য কেউ জানতেন কি না সন্দেহ আছে। তাঁদের জ্ঞানের এই সীমাবদ্ধতার কারণে তাঁদের মধ্যে যতটুকুই সম্ভাবনার প্রাচুর্য থাকুক না কেন, যেকোনো মৌলিক সৃজনশীলতা দেখানোর প্রয়াস, তাদের নিজেদের জন্য রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল হতো। যার জলজ্যান্ত প্রমাণ গ্রামসি ও তাঁর সঙ্গীরা। যদিও পাঁচ বছরের মধ্যেই এই অংশটি নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু তত দিনে তাদের আর কিছুই করার ছিল না।
দুঃখজনক হলেও এটা সত্য যে পৃথিবীর ইতিহাসে এ পর্যন্ত যে দুটি ফ্যাসিবাদ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা এসেছে গণতন্ত্রের পথ বেয়েই। চূড়ান্ত মোহ, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ঐকান্তিক ইচ্ছাই গণতান্ত্রিক নেতৃত্বকে ফ্যাসিবাদের দিকে তাদের অজান্তেই ঠেলে দেয়। সমাজের যে অংশটি এই উত্থানে ভূমিকা রাখে সেটি কিন্তু খুব খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে এ পথে পা বাড়ায় না। হতাশাগ্রস্ত নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশের আকাশছোঁয়া আকাঙ্ক্ষা এবং হঠাৎ এক সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপ্লবে জাতীয় জীবনের সব হতাশা কাটিয়ে ওঠার দুরন্ত কিন্তু অসম্ভব এক ভাবনা মাথায় নিয়ে এরা এ ধরনের মানবতাবিরোধী এক কাজে নেমে পড়ে। আর এদের সঙ্গে হাতে হাত, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ায় সুধীসমাজেরই একটি অংশ, যারা সুযোগসন্ধানী অথবা দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের সহজ পন্থা খোঁজার ভ্রান্ত ধারণায় আচ্ছন্ন।
যেকোনো ফ্যাসিবাদী উত্থানের প্রথম পর্বে ফ্যাসিবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ থাকে না। ফ্যাসিবাদ লুকিয়ে থাকে দেশপ্রেম বা ধর্মের অন্তরালে। যে কারণে অনেক দেশপ্রেমিক ব্যক্তিকেও মনে হবে দেশদ্রোহী। যেমন পঞ্চাশের দশকে আমাদের দেশে কমিউনিস্ট শব্দটিই ছিল দেশদ্রোহী একটি গালি। যদি দেশ আবার ফ্যাসিবাদের দিকে ধাবিত হয় তবে হয়তো সেটি অন্য একটি শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হবে। আর এই দেশদ্রোহিতা রুখতে গিয়ে ব্যক্তিসত্তা, ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে শুরু করে মিডিয়ার কণ্ঠ রোধ করা শুরু হয়। এভাবে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করার পর শুরু হয় নিজের ক্ষমতা চূড়ান্ত করার চেষ্টা। এই লক্ষ্যে প্রথমেই আশ্রয় নেওয়া হয় গোয়েবলসের থিওরি, অর্থাৎ বারবার একটি মিথ্যা বলতে থাকলে মানুষ সেটাকে একসময় সত্য বলে গ্রহণ করে। এই থিওরি বহুল প্রচারিত হওয়ার কারণে আজকাল খুব একটা ফলপ্রসূ বা কার্যকর নয়। সাধারণ সচেতন মানুষের কাছেও ওই থিওরি আজকাল গ্রহণযোগ্যতা পায় না।
বর্তমানকালে, ক্যাপিটালিজমের চূড়ান্ত সময়ে, নতুন নতুন থিওরিস্টরা নিত্যনতুন থিওরি প্রয়োগ করে চলেছেন। তার একটি যেমন, সংবাদ পরিবেশনের সময় সংবাদের একটি অংশ না বলা বা সেই অংশটিকে হালকা করে জানান দেওয়া। আজকালকার ইন্টারনেটের যুগে বেশির ভাগ সচেতন মানুষ সংবাদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করে এবং সংবাদ সম্পর্কিত সমসাময়িক জ্ঞান না রাখা মানেই অন্ধকার যুগের বাসিন্দা হয়ে পড়া বলে মনে করে। আর এই সুযোগটাই নেয় বর্তমানের ফ্যাসিবাদী চরিত্রগুলো এবং তথ্যের বিভ্রান্তি ঘটিয়ে মানুষকে ভুল তথ্যের দিকে ধাবিত করে। সুতরাং সংবাদের সঙ্গে থাকতে চাইলে এখন আসলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা ছাড়া উপায় নেই।
একটি মজার কিন্তু পুরনো গল্প দিয়ে লেখাটি শেষ করি। প্রথমেই বলে নিই, সেসনা ১৫২ একটি দুই সিটের ছোট্ট উড়োজাহাজ। ‘যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমে একবার ফলাও করে খবর এলো, একটি সেসনা ১৫২ স্থানীয় একটি গোরস্তানে ক্র্যাশ করেছে। উদ্ধারকর্মীরা এ পর্যন্ত ৪০০ লাশের খোঁজ পেয়েছে। ’ খবরটির সত্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। এখন এই সংবাদ যদি পাঠকের মধ্যে প্যানিক তৈরি করে সেটা সংবাদপত্রের দোষ নয়। গোরস্তান শব্দটি যদি না লেখা থাকত তবে হয়তো এটাকে হলুদ সাংবাদিকতা বলা যেত। এখন গোরস্তানে লাশ থাকবে না তো কি থাকবে।
পৃথিবীজুড়ে অর্থনৈতিক আধিপত্য নিতে যে রণহুংকার শুরু হয়েছে, সেই হুংকারের বাইরে আমাদের দেশ নয়। আমাদের স্বার্থও এখানে জড়িত। আমাদের দেশেও রয়েছে ভেস্টেড কোয়ার্টারের তীক্ষ দৃষ্টি। যে কারণেই আমাদের সীমান্তজুড়ে শুরু হয়েছে ধর্মীয় রাজনীতির চূড়ান্ত উন্মাদনা। এই উন্মাদনার আঁচ আমাদের ক্ষতবিক্ষত করে দিতে পারে। দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ফিফথ কলামও বসে থাকবে না। তারা চলবে তাদের নিজস্ব চিন্তাচেতনা নিয়ে। আর সেই উন্মাদনায় শুধু আমরাই পুড়ে মরব, সেটা যদি কেউ ভেবে থাকে, তবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। পাশের ঘরের আগুন নিজের ঘরে আসাটা সময়ের ব্যাপার। তবে আমাদের মতো মানুষের বটবৃক্ষ হওয়া ছাড়া বোধ হয় করণীয় কিছুই নেই। চুপচাপ ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকো। সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগও বোধ হয় পাব না। পৃথিবীর জ্ঞাত ইতিহাস অনুযায়ী ফ্যাসিবাদী দেশগুলোর পরিণতি বেশ করুণ। নিজেদের শুধু নয়, আশপাশের সব কিছু তারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে।
ফ্যাসিজমের নেতাদের শেষ যেমন ভালো না, তেমনি ফ্যাসিবাদে আক্রান্ত দেশেরও অপরের সহযোগিতা ছাড়া আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর ইতিহাস আমাদের জানা নেই।
লেখক : রাজনীতিবিদ
#কালের কন্ঠ
More News Of This Category