দৃক নিউজ২৪ ডেস্ক:- বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে নাফ নদী পার হলেই মিয়ানমারের মংডু। আরাকানের উত্তরের এই অঞ্চলেই রোহিঙ্গাদের বাস। অন্যদিকে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের উভয় দেশভুক্ত গ্রাম তুম্বরু। তুম্বরু দু’ভাগ হয়ে বসেছে সীমান্ত পিলার ও কাঁটাতারের বেড়া। তারপরই নো-ম্যানস ল্যান্ড বা জিরো পয়েন্টের বাংলাদেশ অংশ। এ দুই দিক থেকেই হাজার হাজার রোহিঙ্গারা ঢুকছে বাংলাদেশে। উভয় দেশের সীমান্তরক্ষীর পাহাড়ায় তারা সেখানেই আটকে পড়ে মানবতার জীবন-যাপন করছেন।
দুই থেকে ১২ দিনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত রোহিঙ্গারা খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টিতে, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় চরম মানবতার জীবন কাটাচ্ছেন তারা। জ্বর, ডায়েরিয়াসহ নানা অসুখে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। রয়েছে চরম দুর্ভোগে। খাদ্য ও পানীয় সংকটে ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত মানুষের কান্নাকাটি, বিলাপ, কাড়াকাড়িতে ভারি হয়ে উঠেছে সেখানকার পরিবেশ। ছোট্ট পাহাড়ি ঝিরি তুম্বরু খালের পাড়ে দিন দিন মৃত্যুর তাড়া খাওয়ায় নিঃস্ব মানুষের সংখ্যা বাড়ায় সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। ত্রাণ ও চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা না পৌঁছানোয় সৃষ্টি হয়েছে অমানবিক পরিস্থিতি। আজ তাদের দেশ বলে কিছু নেই। জাতিসংঘ হতে তাদের নাম দেয়া হয়েছে জগতের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী হিসাবে। কিন্তু কেন? আসলে এই রোহিঙ্গারা কারা বা কী তাদের পরিচয়? মিয়ানমারে কেনই বা তাদের এত সংকট? পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হল।
রোহিঙ্গা কারা?
অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের মধ্য দিয়ে আরাকানে মুসলমানদের বসবাস শুরু হয়। এই অঞ্চলের বসবাসরত মুসলিম জনগোষ্ঠিই পরবর্তীকালে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে।
নবম-দশম শতাব্দীতে আরাকান রাজ্য ‘রোহান’ কিংবা ‘রোহাঙ’ নামে পরিচিত ছিল, সেই অঞ্চলের অধিবাসী হিসেবেই ‘রোহিঙ্গা’ শব্দের উদ্ভব। ঠিক কবে থেকে এই শব্দ ব্যবহৃত হয়ে আসছে, তার সঠিক কোন সময় জানা যায়নি।
রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে এভাবে, সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি। এই রহম থেকেই এসেছে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি।
তবে মিয়ানমার সরকার ‘রোহিঙ্গা’ বলে কোনো শব্দের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। রোহিঙ্গারা পূর্বতন বার্মা, অধুনা মিয়ানমারের পশ্চিম অঞ্চলের মুসলমান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। সংখ্যায় প্রায় ২০ লাখ রোহিঙ্গা, অধিকাংশ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের পাশে উত্তর রাখাইন রাজ্য নামে নামকরণ করা পূর্ববর্তী আরাকান রাজ্যের তিনটি টাউনশিপে বাস করে।
সীমান্তে আটকা লাখো রোহিঙ্গার মানবিক বিপর্যয়
গত কয়েক দিন ধরে কক্সবাজারের কুতুপালং থেকে শুরু করে থাইংখালী পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পাহাড়ে পাহাড়ে বাঁশ আর পলিথিনের অসংখ্য ঝুপড়ি গড়ে তুলেছে তারা। রোহিঙ্গাদের নতুন বসতি দেখা গেছে টেকনাফ সীমান্তবর্তী হোয়াইক্যং ইউনিয়নসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকাতেও।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্তের জলপাইতলি এলাকায় ত্রিপল টানিয়ে থাকছে কয়েক’শ রোহিঙ্গা। তাদের বাড়ি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায়। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা ওই রোহিঙ্গাদের ঘিরে রেখেছেন। তবে তাদের মানবিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে গত দুই দিনে প্রায় এক হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়িতে ঢুকেছে। উখিয়ার অনিবন্ধিত বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের (ক্যাম্প) সভাপতি মোহাম্মদ হারুন বলেন, গত শনিবার রাতে শুধু তাঁদের শিবিরেই মিয়ানমার থেকে নতুন করে আসা ১০০ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় হাজারো রোহিঙ্গা অপেক্ষা করছে। সুযোগ পেলে তারা বাংলাদেশে ঢুকবে। তিনি বলেন, উখিয়ার পানবাজার এলাকায় অন্তত ৩০০ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ ও বিজিবি। তাদের হয়তো মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে।
সীমান্ত পরিস্থিতি দেখতে এসে বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন ঘুনধুম সীমান্তচৌকিতে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ সীমান্তে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে বিশ্বাসী। সীমান্তে সাময়িক কিছু সমস্যা হয়েছে। এতে দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে না। মিয়ানমারের যে সমস্যা তা কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সমাধান করা জরুরি। মিয়ানমারের উচিত তার দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা দেওয়া।
পূর্ব পাকিস্তানে যোগ দিতে চেয়েছিল রোহিঙ্গারা
১৭৮৪ সালে ব্রিটিশরা আরাকান দখল করে নিলে আবারও বাংলা ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বর্মার যোগাযোগ বেড়ে যায়। এ সময় বর্মার বনজ সম্পদ আহরণ ও অন্যান্য কাজে ব্রিটিশরা ব্যাপকসংখ্যক ভারতীয়কে মিয়ানমারে নিয়ে যায়। ভাগ্যান্বষণে অনেক ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালিরাও সেখানে ভিড় করে। স্থানীয় রাখাইনদের তুলনায় তারা ব্রিটিশদের কাছে বেশি গুরুত্ব লাভ করে এবং সরকারি পদে আসীন হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গোড়ার দিকে, ১৯৪২ সালে, জাপানিরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে মিয়ানমার দখল করে নেয়। স্থানীয় রাখাইনরা এ সময় জাপানিদের পক্ষ নিয়ে ব্রিটিশদের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত জনগণকে আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণের শিকার হয় মূলত রোহিঙ্গা মুসলমানরা। ১৯৪২ সালের ২৮ মার্চ রাখাইন অধ্যুষিত মিমবিয়া ও ম্রোহাং টাউনশিপে প্রায় পাঁচ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করে রাখাইনরা। পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে উত্তর রাখাইন অঞ্চলে প্রায় ২০ হাজার রাখাইনকে হত্যা করে রোহিঙ্গারা। সংঘাত তীব্র হলে জাপানিদের সহায়তায় রাখাইনরা রোহিঙ্গাদের কোণঠাসা করে ফেলে।
১৯৪৫ সাল পর্যন্ত মিয়ানমার জাপানিদের দখলে থাকে। এই তিন বছরে কমপক্ষে ২০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে তৎকালীন বাংলায় চলে আসে। সেই যাত্রা এখনো থামেনি। ১৯৪৫ সালে ব্রিটিশরা আবারও মিয়ানমার দখল করে নেয়। এই দখলে তাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে রোহিঙ্গারা। ব্রিটিশরা এ সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে সহায়তার বিনিময়ে উত্তর রাখাইনে মুসলমানদের জন্য আলাদা একটি রাজ্য গঠন করে দেবে তারা। কিন্তু আরো অনেক প্রতিশ্রুতির মতোই ব্রিটিশরাজ এই প্রতিশ্রুতিও রাখেনি।
১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ ভাগের সময় রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ আরাকান রাজ্যকে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। এ নিয়ে জিন্নাহর সঙ্গে যোগাযোগ করেন রোহিঙ্গা নেতারা। রোহিঙ্গারা একটি বড় সশস্ত্র গ্রুপও তৈরি করে এবং মংদু ও বুথিধাং এলাকাকে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে উদ্যোগ নেয়। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, রোহিঙ্গাদের এই উদ্যোগ ছিল আত্মঘাতী এবং মিয়ানমারে বৈষম্যের শিকার হওয়ার পেছনে এটি একটি বড় কারণ। মিয়ানমারের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা সেই সময়কার রোহিঙ্গা উদ্যোগকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিহ্নিত করে এসেছে। ১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর ধীরে ধীরে রোহিঙ্গাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৭০ সালের পর থেকে সেনাবাহিনীতে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী থেকে নিয়োগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর আগে থেকে সরকারি চাকরিতে থাকা রোহিঙ্গারা ব্যাপক বৈষম্যের শিকার হয়।
যে সময় থেকে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগের শুরু
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের আরাকান রোহিঙ্গাদের স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়। এক সময়ে ব্রিটিশদের দখলে আসে এ ভূখণ্ড। তখন বড় ধরনের ভুল করে তারা এবং এটা ইচ্ছাকৃত কিনা, সে প্রশ্ন জ্বলন্ত। তারা মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। কিন্তু তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এ ধরনের বহু ভুল করে গেছে ব্রিটিশ শাসকরা।
ভারত ভাগ হওয়ার সময়ই রোহিঙ্গাদের মধ্যে গড়ে ওঠা কট্টর ইসলামপন্থী মুজাহিদিন দল গোলমাল বাঁধায়। তারা জিন্নার সঙ্গে দেখা করে বলে ‘আমরা পাকিস্তানের অংশ হতে চাই, রাখাইনের পূর্বাঞ্চল পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে জুড়ে দাও’। তবে রোহিঙ্গা নেতাদের জুড়ে দেওয়ার এই অনুরোধ জিন্নাহ রাখেননি।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়।
দেশভাগ হওয়ার পর থেকে মুজাহিদিনরা রাখাইনের পূর্বাঞ্চলকে মিয়ানমার থেকে আলাদা করার সশস্ত্র আন্দোলন চালিয়ে যায়। ওরাই এক সময় রাখাইনের পুর্বাঞ্চল শাসন করতে শুরু করে। এ সময় বাংলাদেশ থেকেও মুজাহিদিনদের আমন্ত্রণে প্রচুর মুসলিম রাখাইনে এসে মিয়ানমার সরকারের বিনা অনুমতিতে বসত শুরু করে।
প্রতিক্রিয়ায় রাখাইন অঞ্চলের শত শত বৌদ্ধ ভিক্ষু মুজাহিদিনদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। এরপরই মিয়ানমার সরকার মুজাহিদিনদের শক্তি চুরমার করে দিতে উদ্যোগ নেয়। একদিন মুজাহিদিনদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয় মিয়ানমার আর্মি। নেতাদের অনেকেই মরেছে, কেউ পালিয়েছে। এসব ঘটেছে এক দশকের মধ্যেই।
মুজাহিদিনদের বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ডের কারণে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ভোটাধিকার কেড়ে নেয়। শুরু হয় ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে নানা অত্যাচার। নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়া হয়। হত্যা-ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। বিয়ে করার অনুমতি নেই। সন্তান হলে নিবন্ধন নেই। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ। মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ‘কালা’ নামে পরিচিত। বাঙালিদেরও তারা ‘কালা’ বলে।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও বৌদ্ধ রাখাইনদের সাম্প্রদায়িক আক্রমণের শিকার হয়ে প্রায় ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
রোহিঙ্গারা যখন রাষ্ট্রহারা হয়ে পড়ে
১৫ অক্টোবর ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা নাগরিকত্ব আইন প্রকাশ করে। এই আইনে মিয়ানমারে তিন ধরনের নাগরিকত্বে বিধান রাখা হয়_পূর্ণাঙ্গ, সহযোগী এবং অভিবাসী। এই নতুন আইনে বলা হয়, ১৮২৩ সালে মিয়ানমারে ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার পূর্ববর্তী সময়ে মিয়ানমারে বাস করা ১৩৫টি গোত্রভুক্ত মানুষই মিয়ানমারের পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে গণ্য হবে।
রোহিঙ্গাদের গোত্র হিসেবে অস্বীকার করে সামরিক সরকার। তারা দাবি করে ‘রোহিঙ্গা’ বলে কোনো গোত্র তাদের দেশে নেই, এই জনগোষ্ঠী আদতে পূর্ব বাংলা থেকে যাওয়া অবৈধ জনগোষ্ঠী, যারা ব্রিটিশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় পরবর্তী মিয়ানমারে আশ্রয় নিয়েছে। নতুন আইন অনুযায়ী তারা মিয়ানমারের নাগরিক হতে পারবে না।
মিয়ানমারের সামরিক সরকার ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে আরাকান রাজ্যের দীর্ঘ কয়েক শতাব্দীর সামাজিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগকে অস্বীকার করে। আইনে ‘সহযোগী নাগরিক’ হিসেবে শুধু তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়, যারা ১৯৪৮ সালের নাগরিকত্ব অ্যাক্টে ইতোমধ্যে আবেদন করেছে। এ ছাড়া ‘অভিবাসী নাগরিক’ (মিয়ানমারের বাইরে জন্ম নিয়েছে এমন মানুষদের নাগরিকত্ব) হিসেবে কয়েকটি শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়, যেগুলো ‘যথাযোগ্যভাবে প্রমাণসাপেক্ষ’ বলে বলা হয়, যারা মিয়ানমারের স্বাধীনতার আগে (৪ জানুয়ারি ১৯৪৮) এ দেশে প্রবেশ করেছে, মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় ভাষায় দক্ষ এবং যাদের সন্তান মিয়ানমারে জন্মগ্রহণ করেছে, তারাই এই ধারায় নাগরিকত্ব পেতে পারে।
যুগ যুগ ধরে আরাকানে থাকা রোহিঙ্গাদের পক্ষে ১৯৪৮ সালের আগে প্রবেশ করা সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ উপস্থাপন করা ছিল অসম্ভব। এ ছাড়া বৃহত্তর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা প্রধানত নিরক্ষর এই জনগোষ্ঠীর পক্ষে মিয়ানমারের রাষ্ট্রভাষায় ‘দক্ষতা’ প্রমাণ হয়ে পড়ে দুরূহ; কারণ রাষ্ট্রীয়ভাবে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন যে ‘কেন্দ্রীয় কমিটি’ এই নাগরিকত্ব প্রদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল, তারা প্রায় প্রকাশ্যেই রোহিঙ্গাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব দেখায়। সুতরাং রোহিঙ্গারা আর নাগরিকত্ব পায় না। তারা হয়ে পড়ে উদ্বাস্তু, কয়েক পুরুষ ধরে বাস করা নিজেদের ভিটেমাটিতে তারা হয়ে পড়ে কয়েদী। বিশ্বের বুকে জন্ম নেয় রাষ্ট্রবিহীন সবচেয়ে বড় জনগোষ্ঠী।
মিয়ানমারের সরকারি কর্মকর্তারা প্রায়ই প্রকাশ্যে এই রোহিঙ্গাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশি হিসেবে আখ্যায়িত করে বক্তব্য দিয়ে থাকেন। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করেন না। তবে নিজেদের সভ্যদেশ হিসেবে প্রমাণ করতে হলে মিয়ানমারের উচিত দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা। একটি দেশের মধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী বাস করে আসা বড় একটি জনগোষ্ঠী নাগরিকত্ববিহীন থাকতে পারে না। পৃথিবীর সব মানুষেরই একটি দেশ পাওয়া জন্মগত অধিকার, মিয়ানমারের শাসকরা গায়ের জোরে সেই অধিকার অস্বীকার করবেন, সেটি চলতে পারে না।
রোহিঙ্গা প্রশ্নে কার কী অবস্থান
রাখাইন অঞ্চলের রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব অথবা বৈধভাবে বসবাসের অনুমতি দিতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।
জাতিসংঘের এক বিবৃতিতে বলা হয়, অগাস্টের শেষ দিকে নতুন করে সহিংসতা শুরুর পর প্রায় সোয় এক লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে পালিয়ে বাংলাদেশের পথে পা বাড়িয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা-আইওএম এর পরিচালক (অপারেশনস) মোহাম্মদ আবদিকার বলেন, রাখাইনের পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার আগেই আরও বহু মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়বে, তার স্পষ্ট লক্ষণ তারা দেখতে পাচ্ছেন। পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক সহায়তা না পেলে এই রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগের শেষ থাকবে না।
মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের মুখে পালিয়ে আসা পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বাংলাদেশ বহন করে চলেছে গত কয়েক দশক ধরে। বাংলাদেশ সরকার তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এলেও মিয়ানমার তাতে সাড়া দেয়নি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, গতবছর অক্টোবরে রাখাইনে সহিংসতার পর রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুরু হলে উখিয়ার বালুখালিতে বনবিভাগের কাছে ৫০ একর জমি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। গত বছর আসা কয়েক হাজার রোহিঙ্গা সেখানে আছে। নতুন করে যারা আসছে, তাদেরও সেখানে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করার কথা ভাবছে জেলা প্রশাসন।
More News Of This Category