মাও: মো: আবু সাঈদ সৈয়দ:- ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন রাসূল বংশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং নবুয়তের একটি নির্যাস। অনেক সদগুণের আধার ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন একাধারে সাহাবি, মুহাদ্দিছ, আহলে বায়তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লামর সম্মানিত সদস্য ও পবিত্র ইমাম। এছাড়াও খোদাভীতি, ইবাদত-বন্দেগী, দানশীলতা, পরোপকারীতা ও উত্তম চরিত্রে তিনি ছিলেন কিংবদন্তি মহামানব।
জন্ম ও বংশ পরিচিতিঃ
ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ৪ শাবান রোজ মঙ্গলবার ৪ হিজরিতে জন্ম গ্রহণ করেছেন।(আল্লামা জামি,শাওয়াহেদুন নবুওয়াত,ইসলামিক পাবলিশার,দিল্লি,পৃ.৪০৯।) তাঁর নাম হোসাইন। তিনি জন্ম গ্রহণের পর তাঁর পিতা হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু তাঁর নাম রাখেন হারব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে দেখতে এসে জিজ্ঞেস করলেন তাঁর নাম কী? হযরত আলি বল্লেন,তাঁর নাম হারব। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন তাঁর নাম হারব নয় ; বরং তাঁর নাম হোসাইন।(ইবনুল আছির,উসুদুল গাবাহ.দারুল ফিকর,বৈরুত,১৪০৯ হি,খ.১,পৃ.৪৯৬।) উপনাম হলো আবু আব্দুল্লাহ। তাঁর একাধিক উপাধি রয়েছে যেমন ১.সিবতুর রাসূল ২. শহিদ ৩.যকি ৪.সাইয়িদুশ শোহাদাহ ৫. রাশিদ ৬.আত্-তাইয়িব ৭.আল অসি ৮. আত্-তক্বি ৯. আল-মুজাহিদ ইত্যাদি।(ড.আ.ন.ম.মুনির আহমদ,আহলে বায়তঃএকটি পর্যালোচনা,শাহাদাতে কারবালা,সংখ্যা ৬ষ্ট,প্রকাশকালঃ ২৭ নভেম্ববর ২০১১,পৃ.৪২; আল্লামা জামি,প্রাগুক্ত।) তাঁর পিতার নাম হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এবং মাতার নাম হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা।
অবয়বঃ
ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু অত্যন্ত সুন্দর আকৃতির ছিলেন। তাঁর চেহারা মোবারক এতই উজ্জ্বল ছিলো যে,তিনি যখন কোন অন্ধকারে বসতেন তখন সেখানকার অন্ধকার আলোকিত হয়ে যেতো। (আল্লামা জামি,প্রাগুক্ত,পৃ.৩০২।) তাঁর বক্ষ মোবারক থেকে পা মোবারক পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে মিল ছিলো। এ প্রসঙ্গে হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন- الحُسَيْنُ أَشبَهُ بِرَسُوْلِ اللهِ –صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ صَدْرِهِ إِلَى قَدَمَيْهِ অর্থাৎ তাঁর বক্ষ মোবারক থেকে পা মোবারক পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ আলাহিস সালামের সাথে মিল ছিলো।( ইমাম যাহাবি,সিয়ারু আলামিন নুবালা,দারুল হাদিস,কায়রো,১৪২৭হি,খ.৪,পৃ.৩৪৮।)
শিক্ষা জীবন:
তিনি একজন বড় আলেম এবং মুহাদ্দিস ছিলেন। তাঁর যুগের মানুষ তাঁর নিকট ফতোয়া চাইতেন। তিনি অত্যন্ত সাবলিল ভাষায় নজিরবিহিন বক্তব্য রাখতেন।( আমিনুল কাদেরি,তারিখে কারবালা,রেজভি কিতাব ঘর,দিল্লি,১৪১২হি,পৃ.২৬৫-২৬৬।) তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ১২৯ টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি রাসূলুল্লাহ,স্বীয় পিতা হযরত আলি,স্বীয় মাতা হযরত ফাতিমা,হযরত উমর ,হযরত হিন্দা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম প্রমুখের নিকট থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তাঁর থেকেও অসংখ্য বর্ণনাকারী হাদিস বর্ণনা করেছেন যেমন হযরত বিশর বিন গালিব আসদি,হযরত ছুয়াইর বিন আবি ফাখতাহ,স্বীয় ভাই হযরত হাসান,স্বীয় ভাইপো হযরত যায়েদ বিন হাসান,সাঈদ বিন খালিদ,সিনান বিন আবি সিনান,ত্বালহা বিন উবাইদুল্লাহ,হযরত আমির আশ-শাবি,হযরত আব্দুল্লাহ বিন আমর,হযরত উবাইদ বিন হুনাইন,হযরত ইশরামাহ,স্বীয় সন্তান ইমাম যয়নুল আবেদিন,স্বীয় পৌত্র ইমাম বাক্বির,হযরত হুমাম বিন গালিব ফারাযদাক্ব,হযরত ইউসূফ বিন মাইমূন,স্বীয় কন্যা হযরত সকিনা ও ফাতিমা প্রমুখ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম।( হাফিয মিজ্জি,তাহযিবুল কামাল,মুয়াসসাসাতুর রিসালা,বৈরুত,১ম সংস্করণ,১৪০০ হি,খ.৬,পৃ.৩৯৭।)
ইবাদত বন্দেগীঃ
তিনি অত্যন্ত বেশি ইবাদত করতেন। তিনি সারা দিন এবং সারারাত ইবাদতে লিপ্ত থাকতেন।তিনি সর্বদা তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন এবং কুরআন তেলাওয়াত করতেন আর আল্লাহর স্মরণে সদা মশগুল থাকতেন এমনকি তিনি শাহাদাত বরণের আগ মুহুর্ত পর্যন্ত কোন নফল নামাজ পর্যন্ত ত্যাগ করেননি। তিনি শাহাদাতের আগ মুহুর্তেও দুই রাকাত নামায আদায় করেছেন।( আমিনুল কাদেরি,প্রাগুক্ত,পৃ.২৬৩।) আল্লামা ইবনুল আছির বলেন- وكان الحسين رضي اللَّه عنه فاضلًا كثير الصوم، والصلاة، والحج، والصدقة، وأفعال الخير جميعها অর্থাৎ হযরত ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু ছিলেন একাধারে মর্যাদাবান,অত্যাধিক রোযাদার,নামাজ আদায়কারী,হজ্জ্ব পালনকারী,সদকা প্রদানকারী এবং সকল সৎকর্মকারী।( ইবনুল আছির,প্রাগুক্ত,খ.১ম,পৃ.৪৯৮।) তিনি পদব্রজে পঁচিশবার হজ্জ্ব করেছেন। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ বিন উবাইদ বলেন- حجّ الحسين بن علي رضي الله عنه خمساً وعشرين حجَّةً ماشياতিনি পদব্রজে পঁচিশবার হজ্জ্ব পালন করেছেন।( ইবনুজ জাওযি,সিফাতুস সাফওয়া,দারুল হাদিস , কায়রো,১৪২১ হি,খ.১,পৃ.৩০১;ইমাম যাহাবি,প্রাগুক্ত,খ.৪,পৃ.৩৫৩।)
দানশীলতাঃ
ইবন আছির বর্ণনা করেছেন যে,তিনি অত্যন্ত দানশীল ছিলেন।( ইবনুল আছির,প্রাগুক্ত।) যখনই তাঁর নিকট কোন ফকির আসত,তখন তাঁর নিকট যা থাকত,তা দিয়ে দিত। যেমন একদা এক ফকির তাঁর দরবারে এসে আরজ করলেন,হুজুর,আমি অত্যন্ত গরিব আর আমার পরিবার অনেক বড়। আমার কিছু টাকার প্রয়োজন। হুজুর এ কথা শুনে তাকে বললেন,তুমি বস। কিছুক্ষণ পর জনৈক ব্যক্তি পাঁচ থলে দিনার নিয়ে তাঁর দরবারে উপস্থিত হলো। ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু পাঁচ থলে দিনার ঐ ফকিরকে দিয়ে দিলেন এবং নিজের জন্য কিছুই রাখেননি।( আব্দুর রহমান চিশতি,মিরাতুল আসরার,মাকতাবাতু জামে নূর,দিল্লি,১৪১৮ হি,পৃ.২০০-২০১।)
দাম্পত্য জীবনঃ
তাঁর দাম্পত্য জীবন খুবই সুন্দর ছিলো। তাঁর কতিপয় স্ত্রী ছিলো। তাঁরা হলেন-১.লাইলা অথবা বিরক্ষারহ বিনতে আবি উরওয়া আবনে মসউদ আস সাকাফী। তিনি হযরত আলি আকবরের মাতা ছিলেন। ২.শাহ যেনান বা শহরবানু। পারস্য সম্্রাট ইয়াযদাযদিদের কন্যা। ইনি হযরত ইমাম জয়নুল আবেদিনের মাতা ছিলেন। ৩.রিবাব বিনতে ইমরাউল কায়স আল-আফি। ইনি ছিলেন হযরত আলি আসগর এবং হযরত সকিনার মাতা। ৪. বল্লা সম্প্রদায়ের জনৈক রমনী। ইনি হযরত জফরের মাতা। তাঁর ছার ছেলে ও পাঁচ মেয়ে ছিলো। ছেলে সন্তানরা হলেন-১.ইমাম জয়নুল আবেদিন ২.হযরত আলি আকবর শহিদে কারবালা ৩.হযরত আলি আসগর শহিদে কারবালা ও ৪. হযরত জাফর রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম। মেয়ে সন্তানরা হলেন-১. হযরত সকিনা বিনতে রিবাব । তাঁর স্বামীর নাম হযরত যায়েদ বিন আমর বিন উসমান বিন আফফান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম। ২.ফাতেমা । তাঁর স্বামী হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবন উসমান ইবন আফফান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম। ৩. যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা । ৪. হযরত রুকাইয়া রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ৫. হযরত খাওলা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা । ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এক পুত্র সন্তান এবং দুজন কন্যা সন্তান রেখে যান। কাশফুল গুম্মাহ কিতাবে বর্ণিত আছে যে,তাঁর ছয় ছেলে তিন কন্যা। ছেলেরা হলেন-ইমাম জয়নুল আবেদিন,হযরত আলি আকবর ,হযরত আলি আসগর,্হযরত মুহাম্মদ,হযরত জাফর,হযরত আব্দুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম। কন্যারা হলেন-হযরত যয়নব,হযরত রুকাইয়া এবং হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম।( ড.আ.ন.ম.মুনির আহমদ,প্রাগুক্ত,পৃ.৪২।) মিরাতুল আসরার গ্রন্থকার বলেন-তাঁর চার ছেলে দুই মেয়ে ছিলো।( আব্দুর রহমান চিশতি,প্রাগুক্ত,পৃ.২০২-২০৩।)
মর্যাদাঃ
আহলে বায়তের মর্যাদা পবিত্র কুরআন – হাদিস দ্বারা স্বীকৃত। ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আহলে বায়তের অর্ন্তভুক্ত ছিলেন। তাঁর মর্যাদা পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা নিুে আলোকপাত করার প্রয়াস পেলাম।
ক.কুরআনের আলোকেঃ
১.আহলে বায়তের পবিত্রতাঃ
আহলে বায়তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পবিত্রতার গুণে গুনান্বিত। তাঁদের পবিত্রতার ঘোষনা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মাজিদে দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন- إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَكُمْ تَطْهِيرًا ‘হে নবি-পরিবার! আল্লাহ তো চান তোমাদের অপবিত্রতা দূর করতে আর তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।’(সূরা আহযাব,আয়াত নং ৩৩।)এ আয়াতখানা অবতীর্ণ হবার ব্যাপারে কয়েকটি প্রেক্ষাপট বর্ণিত রয়েছে। তন্মেধ্যে কয়েকটি হলো:১. হযরত আবূ সাঈদ খুদরি রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছে-‘এ আয়াত শরিফ পাঁচজন ব্যক্তি সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। তাঁরা হলেন,আমি,হযরত আলি,হযরত ফাতিমা,ইমাম হাসান এবং ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম।( আল্লামা আলূসি,রুহুল মায়ানি,দারুল কুতুবিল ইলমির্য়্যাহ,বৈরুত,১ম সংস্করণ,১৪১৫হি,খ.১১,পৃ.১৯৭।) ২. হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস এবং হযরত ইকরামাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম বলেন,এটি উম্মুহাতুল মু’মিনিন সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে।( প্রাগুক্ত,খ.১১,পৃ.১৯৪।) ৩. হযরত উম্মে সালমাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর শয়নের স্থানে খায়বারি চাদর গায়ে দিয়ে আরাম ফরমাচ্ছেন। অত:পর হযরত ফাতিমাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র জন্যে বিশেষ খাবার-ভর্তি একটি পাত্র নিয়ে আসলেন। এটি দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করলেন,হে ফাতিমা! তুমি তোমার স্বামী এবং সন্তানদ্বয় হাসান ও হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমকে ডেকে নিয়ে আসো। তিনি তাঁদেরকে ডেকে আনলেন আর তাঁরা খাবার গ্রহণ করছেন। এমতাবস্থায় আল্লাহ তায়ালা উল্লিখিত আয়াত শরিফ অবতীর্ণ করেন। এ আয়াত শরিফ অবতীর্ণ হবার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলি ,হযরত ফাতিমা,ইমাম হাসান এবং ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমকে তাঁর চাদর দ্বারা আবৃত করে ফেললেন । তারপর তিনি চাদরের ভিতর থেকে হাত মুবারক বের করে আল্লাহর দরবারে হাত তুলে ফরিয়াদ করলেন,‘হে আল্লাহ্! এরাই হলেন আমার আহলে বায়ত এবং আপন-জন । আপনি তাঁদের অপবিত্রতা দূর করুন আর তাঁদেরকে পবিত্র করুন।’(ইমাম তিরমিযি,আস-সুনান,দারুল গারবিল ইসলামি,বৈরুত,১৯৯৮ ইং,খ.৫,পৃ.২০৪।) এ দুয়া তিনি তিনবার করেছেন। হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা বলেন, خَرَجَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غَدَاةً وَعَلَيْهِ مِرْطٌ مُرَحَّلٌ مِنْ شَعْرٍ أَسْوَدَ فَجَاءَ الْحَسَنُ بْنُ عَلِيٍّ فَأَدْخَلَهُ ثُمَّ جَاءَ الْحُسَيْنُ فَدَخَلَ مَعَهُ ثُمَّ جَاءَتْ فَاطِمَةُ فَأَدْخَلَهَا ثُمَّ جَاءَ عَلَيٌّ فَأَدْخَلَهُ ثُمَّ قَالَ: [إِنَّمَا يُرِيدُ اللَّهُ لِيُذْهِبَ عَنْكُمُ الرِّجْسَ أهل الْبَيْت وَيُطَهِّركُمْ تَطْهِيرا] “কোন একদিন সকালে কালো পশমের নকশী করা একটি চাদর পরিহিত অবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইরে বের হলেন । তাঁর নিকট হযরত হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আসলেন আর তিনি তাঁকে চাদরে প্রবেশ করালেন। তারপর হযরত হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আসলেন আর তিনি তাঁকে তাঁর চাদরে প্রবেশ করালেন। তারপর হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা আসলেন আর তিনি তাঁকে চাদরে প্রবেশ করালেন। পরিশেষে হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আসলেন আর তিনি তাঁকেও চাদরে প্রবেশ করালেন এবং ইরশাদ করেছেন-‘ ‘হে নবি-পরিবার! আল্লাহ তো চান তোমাদের অপবিত্রতা দূর করতে আর তোমাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করতে।”(ইমাম মুসলিম,আস-সহিহ,দারু ইহইয়ায়িত তুরাসিল আরবি,বৈরুত,খ.৪,পৃ.১৮৮৩।)
এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আহলে বায়তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অবিত্রতা দূর করতে চান আর তাঁদেরকে পবিত্র করতে চান। তাঁদেরকে অপবিত্রতা কী আর তাঁদেরকে পবিত্র করার অর্থ কী- এ নিয়ে মুফাসসিরগণ কতিপয় মত ব্যক্ত করেছেন । হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা বলেন, নাপাকী বা অপবিত্রতা অর্থ শয়তানের প্ররোচনায় করা হয়,এমন কাজ এবং যে কাজের মধ্যে আল্লাহ তায়ালা কোন সন্তুষ্টি নেই। কেউ কেউ বলেন,এর অর্থ যে কোন মন্দ কাজ।( ইমমা খাযিন,তাফসিরে খাযিন,দারুল ফিকর,বৈরুত,১৩৯৯ হি,খ.৫,পৃ.২৫৯।) কেউ কেউ বলেন,এর অর্থ শিরক,কৃপণতা,লোভÑলালসা,কু-প্রবৃত্তির প্ররোচনা ইত্যাদি। আল্লামা আলূসি আলাইহির রাহমাহ্ বলেন, এখানে রূপকার্থে পাপকে বুঝানো হয়েছে। পবিত্র করার অর্থ সম্পর্কে ইমাম রাজি আলাইহির রাহমাহ্ বলেন, আল্লাহ তাঁদেরকে বাতিল আকিদাহ্ আর মন্দ কাজ থেকে পবিত্র করতে চান।( ইমাম রাজি,তাফসিরে কবির,দারু ইহইয়ায়িত তুরাসিল আরবি,বৈরুত,খ.২৫,পৃ.১৬৭।) আল্লামা আলূসি আলাইহির রাহমাহ্ বলেন,আল্লাহ তাঁদেরকে পরহিজগার বানাতে চান।( আল্লামা আলূসি,প্রাগুক্ত।) উল্লিখিত ব্যাখ্যার আলোকে আয়াতে অর্থ দাঁড়ায়- আল্লাহ তো চান তাঁদেরকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য পাপ থেকে মুক্ত করতে আর পাপ থেকে মুক্ত করে পুত:পবিত্র করতে। মহান রাব্বুল আলামিন যা ইচ্ছা করেন,তা-ই করেন-এ প্রসঙ্গে তিনি ইরশাদ করেছেন- إِنَّ رَبَّكَ فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ ‘নিশ্চয় আপনার প্রতিপালক যা ইচ্ছা করেন,তা-ই করেন।’(.সূরা হুদ,আয়াত নংঃ১০৭।)এতে প্রমাণ হয় যে,আহলে বায়তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন পবিত্র।
২.আহলে বায়তের প্রতি ভালোবাসাঃ
আহলে বায়তের প্রতি ভালোবাসা উম্মতে মুহাম্মদির উপর ফরজ। মহান রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন- قُلْ لَا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْبَى ‘হে প্রিয় হাবিব,আপনি বলে দিন, আমি দ্বীন প্রচারের বিনিময়ে তোমাদের নিকট থেকে আত্মীয়তার সৌহার্দ্য ব্যতীত অন্য কোন প্রতিদান চাই না।’(সূরা শুরা,আয়াত নং ঃ ২৩।) ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আহলে বায়তের একজন উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন। সুতরাং তাঁকেও ভালোবাসা ফরজ।
খ.হাদিসের আলোকেঃ
আহলে বায়তের উল্লেখযোগ্য সদস্য ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু’র মর্যাদা সম্পর্কে অসখ্য হাদিস বর্ণিত রয়েছে। তা থেকে কয়েকটি হাদিস নিুন্ম তুলে ধরলাম।
১.রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
إِنَّ الْحَسَنَ وَالْحُسَيْنَ هُمَا رَيْحَانَتَايَ مِنْ الدُّنْيَا
‘নিশ্চয় ইমাম হাসান এবং হোসাইন উভয় দুনিয়ায় আমার দুটি ফুল।’(ইমাম তিরমিযি,আস-সুনান,দারু ইহইয়ায়িত তুরাসিল আরবি,বৈরুত,খ.৫,পৃ.৫৫৭;ইমাম বুখারি,আল-জাামিউস সহিহ,দারু তুকিন নাজাহ,বৈরুত,১ম সংস্করণ,১৪২২ হি,খ.৫,পৃ.২৭।)
২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- الحسن والحسين سيدا شباب أهل الجنة ‘ইমাম হাসান ও হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা জান্নাতের যুবকদের সরদার।’(ইমাম তিরমিযি,প্রাগুক্ত,খ.৫,পৃ.৬৬০।)
الحسن والحسين سيدا شباب أهل الجنة
৩.হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন- هَذَانِ ابْنَايَ، فَمَنْ أَحَبَّهُمَا فَقَدْ أَحَبَّنِي، وَمَنْ أَبْغَضَهُمَا فَقَدْ أَبْغَضَنِي “এরা দুজন আামার সন্তান। যে ব্যক্তি এ দুজনকে ভালবাসল সে যেন আমাকে ভালবাসল আর যে ব্যক্তি এ দুজনের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করল সে যেন আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করল”।(ইবনুল মুকরি,আল-মু’জাম,মাকতাবাতুর রুশদ,রিয়াদ,১সংস্করণ,১৪১৯ হি,খ.১,পৃ.১৩৩।)
৪. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- مَنْ أَحَبَّهُمَا فَقَدْ أَحَبَّنِي، وَمَنْ أَبْغَضَهُمَا فَقَدْ أَبْغَضَنِي“যে ব্যক্তি তাঁরা দুজনকে(ইমাম হাসান ও হোসাইন) ভালোবাসে সে যেন আমাকে ভালোবাসে আর যে ব্যক্তি তাঁরা দুজনের প্রতি বিদ্বেষ রাখে সে যেন আমার প্রতি বিদ্বেষ রাখে।”(ইমাম আহমদ,আল-মুসনাদ,দারুল হাদিস,কায়রো,১ম সংস্করণ,১৪১৬ হি,খ.৭,পৃ.৫১৯;ইমাম হাকিম,আল-মুসতাদরাক,দারুল কুতুবিল
ইলমিয়্যাহ,বৈরুত,১ম সংস্করণ,১৪১১ হি,খ.৩,পৃ.১৮২।)
৫. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- هَذَانِ ابْنَاىَ وَابْنَا ابْنَتِى اللَّهُمَّ إِنِّى أُحِبُّهُمَا فَأَحِبَّهُمَا وَأَحِبَّ مَنْ يُحِبُّهُمَا “ এরা দুজন (ইমাম হাসান ও হোসাইন) আমার সন্তান এবং আমার পৌত্র। হে আল্লাহ! এরা দুজনকে আমি ভালোবাসি । অতঃপর আপনিও তাঁদেরকে ভালোবাসেন এবং আরো ভালোবাসেন তাদেরকে যার এরা দুজনকে ভালোবাসে।”(ইমাম তিরমিযি,প্রাগুক্ত,খ.৫,পৃ.৬৫৬;ইমাম বুখারি,প্রাগুক্ত,খ.৫,পৃ.২৬।)
৬.হযরত সালমান ফারেসি রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: ্রالْحَسَنُ وَالْحُسَيْنُ ابْنَايَ، مَنْ أَحَبَّهُمَا أَحَبَّنِي، وَمَنْ أَحَبَّنِي أَحَبَّهُ اللَّهُ، وَمَنْ أَحَبَّهُ اللَّهُ أَدْخَلَهُ الْجَنَّةَ، وَمَنْ أَبْغَضَهُمَا أَبْغَضَنِي، وَمَنْ أَبْغَضَنِي أَبْغَضَهُ اللَّهُ، وَمَنْ أَبْغَضَهُ اللَّهُ أَدْخَلَهُ النَّارَ “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছি যে,হযরত হাসান ও হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা আমার সন্তান। যে ব্যক্তি তাঁদেরকে ভালোবাসলো সে যেন আমাকে ভালোবাসলো আর যে ব্যক্তি আমাকে ভালোবাসলো সে যেন আল্লাহ ভালোবাসলো। যে আল্লাহকে ভালোবাসলো আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। যে ব্যক্তি তাঁরা দুজনের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করল সে যেন আমার সাথে বিদ্বেষ পোষণ করলো আর যে ব্যক্তি আমার সাথে বিদ্বেষ পোষণ করল সে যেন আল্লাহর সাথে বিদ্বেষ পোষণ করল। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে বিদ্বেষ পোষণ করল আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।”
৭.রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-حسين مني وأنا من حسين أحب الله من أحب حسينًا“ইমাম হোসাইন আমার থেকে আর আমি ইমাম হোসাইন থেকে। আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন যে ইমাম হোসাইনকে ভালোবাসে।”(ইমাম হাকিম,আল-মুসতাদরাক,দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ,বৈরুত,১ম সংস্করণ,১৪১১হি,খ.৩,পৃ.১৯৪;ইমাম তিরমিযি,প্রাগুক্ত,খ.৬,পৃ.১২৩।)
৮.হযরত বুরাইদা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন-كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَخْطُبُنَا إِذْ جَاءَ الْحَسَنُ وَالْحُسَيْنُ عَلَيْهِمَا قَمِيصَانِ أَحْمَرَانِ يَمْشِيَانِ وَيَعْثُرَانِ فَنَزَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ الْمِنْبَرِ فَحَمَلَهُمَا وَوَضَعَهُمَا بَيْنَ يَدَيْهِ ثُمَّ قَالَ: ্রصَدَقَ اللَّهُ [إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ] نَظَرْتُ إِلَى هَذَيْنِ الصَّبِيَّيْنِ يَمْشِيَانِ وَيَعْثُرَانِ فَلَمْ أَصْبِرْ حَتَّى قَطَعْتُ حَدِيثِي وَرَفَعْتُهُمَا“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে খুতবা দিচ্ছিলেন। ইতঃমধ্যে ইমাম হাসান ও হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা লাল জামা পরিধান করে হেঁটে মসজিদের দিকে আসছিলেন এবং তাঁরা দুজন পরে যাবার উপক্রম হলো। তাই রাসূলুল্লাহ আলাইহিস সালাম মিম্বর থেকে নেমে তাঁদেরকে বহন করে নিয়ে এসে তাঁর সামনে বসালেন। অতঃপর ইরশাদ করেছেন- আল্লাহ তায়ালা সত্য বলেছেন যে,তোমাদের সন্তান ও সম্পদ পরীক্ষা সরূপ। এরপর তিনি ইরশাদ করেছেন-আমি এ দুই শিশুকে হেঁটে আসতে দেখলাম যে,তারা মাটিতে পরে যাচ্ছিল। এ অবস্থা দেখে আমি আর ধৈর্য ধরতে পারিনি এমনকি আমি আমার খুতবা ত্যাগ করে তাদেরকে তুলে নিয়ে আসলাম।”(ইমাম তিরমিযি,প্রাগুক্ত,খ.৬,পৃ.১২২;ইমাম ইবন খুযাইমা ,আস-সহিহ,আল-মাকতাবাতুল ইসলামি,প্রকাশনা ও তারিখ বিহীন,খ.৩,পৃ.১৫২।) এ হাদিস থেকে বোঝা যায় যে,রাসূলুল্লাহর নিকট ইমাম হাসান ও হোসাইন কত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁরা মাটিতে পরে যাবার সম্বভনা দেখে খুতবা বন্ধ করে তাঁদেরকে তুলে নিয়ে আসলেন।
৯.জনৈক গ্রাম্য ব্যক্তি মানত করল যে,একটি হরিণের বাচ্চা রাসূলুল্লাহর দরবারে নিয়ে আসবে। সে তার মানত অনুযায়ী একটি হরিণের বাচ্চা হুজুরের দরবারে নিয়ে আসলেন। রাসূলুল্লাহ এ বাচ্চাটিকে ইমাম হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে দিয়ে দিলেন। এটা দেখে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু হরিণের বাচ্চা নেয়ার জন্যে নানার নিকট দৌঁড়ে আসলেন। নানার নিকট এসে হরিণের বাচ্চা চাইতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলে তিনি কোন রকম বোঝতে নারাজ বরং হরিণের বাচ্চা চাই। ইতঃমধ্যে একটি হরিণ তার বাচ্চা নিয়ে এসে রাসূলের দরবারে উপস্থিত। হরিণটি আরজ করল ,হুজুর,আমার একটি বাচ্চা জনৈক গ্রাম্য ব্যক্তি ধরে এনে আপনার দরবারে উপস্থিত করেছে। এ বাচ্চাকেও আমি আল্লাহ হুকমে ইমাম হোসাইনের জন্যে দিয়ে দিচ্ছ।( মাওলানা আমিনুল কাদেরি,প্রাগুক্ত,পৃ.২৭০।) এ ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, বনের প্রাণীও ইমাম হোসাইনের সন্তুটি চায়।
১০. একদিন ইমাম হাসান ও হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহুমা কিছু লেখা লিখলেন। লিখার পর দুজনই রাসূলুল্লাহর নিকট এসে জানতে চাইলেন কার লেখা বেশি সুন্দর। ফয়সালা করলে তাঁরা কোন কষ্ট পাবে মনে করে তিনি কোন ফয়সালা করেননি বরং তাঁদেরকে হযরত আলি রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুর নিকট পাঠালেন । তিনিও একই রকম মনে করে তাঁদেরকে হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহার নিকট পাঠালেন। তিনি বললেন,আমার নিকট সাতটি মূতি আছে। আমি এগুলো মাটিতে নিক্ষেপ করবো। যে বেশি কুড়াতে পারবে,তাঁর লেখা সুন্দর বলে গণ্য হবে। তিনি সাতটি মূতি মাটিতে নিক্ষেপ করলো। তাঁরা তিনটি তিনটি কুড়িয়ে নিলেন। আল্লাহর হুকমে হযরত জিবরাইল এসে তাড়াতাড়ি অবশিষ্ট মূতিকে দুই ভাগে ভাগ করে দিলেন। ফলে তাঁরা দুজন অর্ধেক অর্ধেক করে নিলেন। রাসূলুল্লাহ এ ঘটনা শুনে ইরশাদ করেছেন-আল্লাহু আকবার! মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইমাম হাসান ও হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমার এ সামান্য অসন্তুষ্টিও দেখতে চাননা।( প্রাগুক্ত,পৃ.২৭০-২৭১।) এ ঘটনা থেকে বোঝা গেলো যে,ইমাম হাসান ও হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা আল্লাহর নিকট কতই প্রিয়।
১১.ঈদের আগের দিন রাতে ইমাম হাসান ও হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা স্বীয় মাতা হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহার নিকট গিয়ে আরজ করলেন,আম্মাজান!কাল ঈদের দিন,সবাই নতুন জামা পরিধান করবে। আমরা কি নতুন কাপড় পরিধান করবো না? তিনি উত্তর দিলেন,তোমাদের চিন্তার কারণ নেই। তোমরাও নতুন কাপড় পেয়ে যাবে। এ কথা বলে তিনি আল্লাহর দরবারে আরজ করলেন-হে আল্লাহ,আপনার প্রিয় হাবিবের নাতিরা আমার নিকট নতুন জামা চাচ্ছেন,আমি তাঁদেরকে নতুন জামা দেব বলে প্রতিশ্র“তি দিয়েছি। আপনার দরবারে হাত পেতেছি। আমার খালি হাত ফেরত দিয়েন না। দোয়া শেষ হবার সাথে সাথে দরজায় কে এসে দরজায় করাঘাত করতেছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,কে? উত্তর আসল,আললে বায়তের দর্জি শাজাদাদের জন্য নতুন কাপড় নিয়ে এসেছে। হযরত ফাতিমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা তার থেকে কাপড়গুলো নিলেন এবং তাঁদেরকে ঈদের দিন পরিধান করালেন। এ ঘটনা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতিমাকে আরজ করলেন,তুমি কি জান কাল রাতে কে কাপড় নিয়ে এসেছে। তিনি বললেন,আপনিই বলুন। রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেছেন,কাল রাত হযরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম আল্লাহর পক্ষ থেকে জান্নাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে এসেছিলো।( প্রাগুক্ত,পৃ.২৭১-২৭২।) এ থেকে বোঝা যায় যে,ইমাম হাসান ও হোসাইনের সামান্যতম পেরেশানিও আল্লাহ তায়ালার সহ্য হয় না। তাঁদেরকে খুশি করার জন্য জান্নাত থেকে কাপড় পাঠিয়ে দিয়েছেন।
কারামতঃ
ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে অসংখ্য কারামত প্রকাশিত হয়েছে। তা থেকে কয়েকটি কারামত নিুে তুলে ধরলাম।
১.ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আহলে বায়তে রাসূলকে হেফাযত করার জন্য তাবুর চারিদিকে আগুন জ্বালিয়ে দিল। এদিকে ইয়াযিদ বাহিনী আব্দুল্লাহ বিন হুজা এসে ইমাম হোসাইনকে উদ্দেশ্যে করে বলতে লাগলেন,হে হোসাইন,তুমি দোযখের আগুনে জ্বলার পূর্বে এখানে আগুন লাগিয়েছ। ইমাম হোসাইন এ কথা শুনে তাকে বললেন,كذبت يا عدو الله ‘হে আল্লাহর শত্র“ ,তুমি মিথ্যা বলেছ’। তুমি কি মনে কর,আমি জাহান্নামের আগুনে জ্বলবো ? তারপর তিনি আল্লাহর দরবারে হাত তোলে আরজ করলেন ,হে আল্লাহ,এ মিথ্যুককে জাহান্নামে আগুনে জ্বলার পূর্বে দুনিয়ার আগুনে জ্বালিয়ে শাস্তি দাও। তিনি হাত নামানোর পরপর ঐ ব্যক্তির ঘোড়া একটি গর্তে আটকে গেলে সে ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। তারপর ঘোড়াটি দৌঁড়তে লাগল আর সে ব্যক্তিও ঘোড়ার পিছনে পিছনে দৌঁড়তে আরম্ভ করলো। শেষ পর্যন্ত ঐ ঘোড়াটি তাকে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করলে তার মৃত্যু হয়।( ইবন কসির,আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া,( বৈরুত ঃ দারু ইহইয়ায়িত তুরাসিল আরবি,১ম সংস্করণ,১৪০৮ হি.),খ.৮,পৃ.১৯৬) এ ঘটনা দেখে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু আল্লাহর দরবারে শোকরিয়ার্থে সিজদা করলেন এবং তাঁর প্রশংসা করে আরজ করলেন,হে আল্লাহ!তুমি আহলে বায়তে রাসূলুর দুশমনকে শাস্তি দিয়েছ। এ কথা শুনে আরেক ইয়াযিদ বাহিনী বলে উঠলেন,আপনার সাথে রাসূলুল্লাহর কী সম্পর্ক? এটা শুনে ইমাম হোসাইন অনেক কষ্ট পেলেন এবং আল্লাহর দরবারে আরজ করলেন,হে আল্লাহ ,এ বেয়াদবকে বেইজ্জত করুন। সাথে সাথে ঐ ব্যক্তির হাজত দেখা দিল এবং সে ঘোড়া থেকে নেমে মাঠের কোন এক প্রান্তরে গিয়ে উলঙ্গ হয়ে বসলে একটি কালো বিচ্ছু তাকে দংশন করল। এ সে উলঙ্গ অবস্থায় সৈন্য বাহিনীদের সামনে আসল এবং লাফাতে লাফাতে মুত্যু হল।( মাওলানা আমিনুল কাদেরি,প্রাগুক্ত,পৃ..৩৯০-৩৯১।)
২.জনৈক ইয়াযিদ বাহিনী ইমাম হোসাইনকে লক্ষ্য করে বলল,হে হোসাইন,দেখো ফুরাত নদী কিভাবে ঢেউ মারছে। আল্লাহর কসম,তুমি এ নদী থেকে এক ফোটা পানিও পাবে না ;বরং পিপাসায় তোমার মৃত্যু হবে। এ কথা শুনে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন- اللَّهُمَّ اقْتُلْهُ عَطَشًا وَلَا تَغْفِرْ لَهُ أَبَدًا ‘হে আল্লাহ,তাকে তুমি পিপাসা দিয়ে মৃত্যু প্রদান করুন এবং তাকে কখনো ক্ষমা করো না।’ তারপর দেখা গেল যে,ঐ ব্যক্তি ঘোড়া থেকে পড়ে গেলো এবং ঘোড়াটি দৌঁড়তে আরম্ভ করল। সেও ঘোড়ার পিছনে পিছনে দৌঁড়তে আরম্ব করল। এভাবে সে অত্যন্ত পিপাসার্ত হলো। সে পিপাসার্ত হয়ে পিপাসা পিপাসা বলে চিৎকার করতে লাগল। তাকে পানি পান করানো হলে সে পানি সাথে সাথে বমি করে দিত আর সে পিপাসা পিপাসা বলে চিৎকার করত। এভাবে পানির এভাবে তার মৃত্যু হলো।( ইবনুল আছির,আল-কামিল ফিত তারিখ,( বৈরুত ঃ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা,১ম সংস্করণ,১৪১৭ হি.,খ.৩,পৃ.১৬৩;ইমাম তাবারি,তারিখুল উমাম ওয়ার রুসুল,( বৈরুত ঃ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা,১ম সংস্করণ,১৪০৭ হি),খ.৩,পৃ.৩১১।) অন্য বর্ণনায় আছে,সে অসুস্থ হয়ে গিয়েছে। তাকে পানি পান করালে সে বমি করে দিত। তাকে যতবার পানি পান করানো হতো,সে ততবার বমি করে দিত। এভাবে পিপাসায় তার মৃত্যু হলো।( ইমাম ইবনুল আছির,আল-কামিল ফিত তারিখ,দারুল কিতাবিল আরবি,বৈরুত,১ম সংস্করণ,১৪১৭হি,খ.৩,পৃ.১৬৩।)
৩. হযরত মিনহাল বর্ণনা করেছেন যে,আল্লাহর কসম,ইমাম হোসাইনে মাথা মোবারককে দামেস্ক নিয়ে যাবার সময় আমি সেখানে ছিলাম এবং সেখানে দেখেছিলাম যে,জনৈক ব্যক্তি ইমাম হোসাইনে মাথা মোবারকের সামনে সূরা কাহাফ পড়ছিলেন। সে পড়তে পড়তে أَمْ حَسِبْتَ أَنَّ أَصْحَابَ الْكَهْفِ وَالرَّقِيمِ كَانُوا مِنْ آيَاتِنَا عَجَبًا [“হে নবি, আপনি কি মনে করেন যে,গুহা ও পাহাড়ের অধিবাসীরা আমার নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি বিস্ময়কর নিদর্শন ছিলো?”] পর্যন্ত পৌঁছালে ইমাম হোসাইনের মাথা মোবারক বলে উঠল-أعجب من أَصْحَاب الْكَهْف قَتْلِي وحملي ‘আমাকে শহিদ করা এবং বহন করে নিয়ে যাওয়াটা আসহাবে কাহাফ থেকেও বিস্ময়কর।’(ইমাম সুয়ূতি,আল-খাসায়িসুল কুবরা,দারুল কিতাবিল ইলমিয়্যাহ,বৈরুত,খ.২,পৃ.২১৬ ; আল্লামা মুহাম্মদ সালেহি আশ-শামি,সুবুলুল হুদা
ওয়ার রাশাদ,( বৈরুতঃ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা,১ম সংস্করণ,১৪১৪
হি.),খ.১১,পৃ.৭৬।)
শাহাদাত বরণঃ
ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু শুক্রবার মতান্তরে শনিবার আশুরার দিনে ৬১ হিজরীতে কারবাল প্রান্তরে ইয়াযিদ বাহিনীর হাতে শহিদ হন।( ইবনুল আছির,প্রাগুক্ত,খ.১,পৃ.৪৯৮।)
লেখক: কালামিষ্ট, ইসলামি চিন্তাবিদ।
জামাল/এস/এস
More News Of This Category