মাওলানা সিরাজুল ইসলাম ফারুকী :- আমাদের দেশে প্রায় মসজিদে খতম তারাবীহ হয়ে থাকে । তারাবীহের নামাজে খুব দ্রুত কোরআন পাঠ করা হয়, যার কারণে আয়াতের শেষ অংশ ছাড়া আর কোনো অংশ পরিস্কারভাবে বুঝার কোনো উপায় থাকে না । এটা কতটুকু সঠিক পঠন? এ ব্যাপারে কোরআন-হাদীসের আলোকে বিষয়টি খোলাসা করার চেষ্টা করছি ।
আমরাতো সাওয়াবের আশায় এবং সাওয়াব লাভের নিমিত্তেই হাফিজ ছাহেবগণ দ্বারা তারাবীহ এর নামাজ পড়ে থাকি । কোরআন মাজীদ আল্লাহর কালাম । তাঁর তিলাওয়াতে রয়েছে প্রতি হরফে ১০ নেকি । আল্লাহ পাক ইচ্ছা করলে আরো আরো বেশিও দিতে পারেন । তাকে তিলাওয়াত করার সময় ধীর-স্থিরতার সাথে (তাজবীদের সাথে) এবং হরফের হক্ব অর্থাৎ মদ্দ, গুন্নাহ, পুর-বারিক ইত্যাদি আদায় করেই পড়তে হবে । মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন ورتل القران ترتيلا অর্থাৎ ধীরস্থিরতার সাথে কোরআন তিলাওয়াত করো (সুরা মুজ্জাম্মিল- আয়াতঃ ০৪) । তাই কোরআন শরীফ পড়তে হলে তাজবীদ সহকারেই পড়তে হবে । তবে ফরজ নামাজ থেকে তারাবীহ এর নামাজে সাধারণতঃ দ্রুত পঠনের নিয়ম রয়েছে । যাকে বলা হয় قراءة حدرية (ক্বিরা’আতে হদরিয়া) । হদরের নিয়ম মতো সহীহ শুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করায় কোনো অসুবিধা নেই । কিন্তু বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেভাবে তারাবীহ এর নামাজ পড়া হয় সেটাকে কোনো ক্রমেই ‘হদর’ পড়া বলা চলে না । আমার মতে, এটা হদর নয় বরং হযর (নিষিদ্ধ) । তাঁদের পড়ার একটি নমূণা বলছি- আল্লাহু আকবার বলেই এক শ্বাসেই সুরা ফাতিহা পড়ে নেন । অথচ আল্লাহু আকবার বলার পর যে ছানা পড়তে হয় (যা মুস্তাহাব) সেদিকে যেন তাঁদের অনেকেরই কোনো খেয়াল নেই বা পড়াকে তাঁরা জরুরী মনে করেন না । ছানার পর ‘আউ’যুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ’ পড়েই সুরা ফাতিহা পড়তে হয় । এই সুরা ফাতিহা এক শ্বাসে না পড়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত মোতাবেক ৭ আয়াত ৭ ওয়াক্বফ করে পড়বেন । তারপর নিয়ম মাফিক অন্যান্য সুরা পড়বেন । পরিতাপের বিষয়, তাঁদের পড়া এতো দ্রুত গতিতে চলে মনে হয় উটের ঘাস চর্বনের আওয়াজ দিয়ে ১০০ গতিবেগে ট্রেন চলছে । তাঁদের এ দ্রুত তিলাওয়াতে ক্বিরা’আতে হদরিয়া (যা বিধিসম্মত) -এর সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার ফলে এ ধরনের তিলাওয়াতে সাওয়াবের কোনো আশা করা যায় না । কেননা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন رب قارئ للقران يلعنه. অর্থাৎ অনেক কোরআন পাঠ কারীকে স্বয়ং কোরআন অভিশাপ দিয়ে থাকে । বর্তমানে যেভাবে দ্রুত পড়া এবং কম সময়ে তারাবীহ খতম করার প্রশংসা করা হয়- এটা নিতান্তই জেহালতী (মূর্খতা) ছাড়া আর কিছুই নয় । কিল্লতে ইলম (স্বল্প জ্ঞান) ও কিল্লতে ফহম (স্বল্প বুঝ) এর কারণেই এমনটি হচ্ছে । অথচ যাঁরা সঠিক নিয়মে সহীহভাবে তারাবীহ পড়ে থাকেন, তাঁদের নামাজে খুব দ্রুত কোরআন তিলাওয়াত কারীদের থেকে মাত্র ১০/১৫ মিনিট সময় বেশি লাগতে পারে । এ ১০/১৫ মিনিটের জন্য তারাবীহ নামাজের সাওয়াব বাতিল করে গুনাহগার হওয়া কতো বড় দূর্ভাগ্যের বিষয়!! আফসোস! আফসোস! তাইতো মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যথার্থই ইরশাদ করেছেন: ‘অনেক রোজাদারের রোজা রাখার বিনিময় ‘ক্ষুধার্ত থাকা’ ছাড়া আর কিছুই হাসিল হবে না । তেমনিভাবে অনেকের রাত্র জাগরণ ও তারাবীহর নামাজ পড়ার বিনিময় ‘জাগ্রত থাকা’ ছাড়া আর কিছুই হাসিল হবে না’।
হাফিজ ছাহেবদের স্মরণ রাখা জরুরী- তাঁরা আল্লাহ পাকের কালাম তিলাওয়াত করছেন । তাঁদের উদ্দেশ্য হবে, কেবল আল্লাহ পাককে সন্তুষ্ট করা । এক্ষেত্রে মানুষের মন তুষ্টি মক্বসুদ না হওয়া চাই । তাঁদের আরো স্মরণ রাখা কর্তব্য যে, তাঁদেরকে মহান আল্লাহ পাক যে নেয়ামত দান করেছেন তা গোটা পৃথিবী থেকে শ্রেষ্ঠ । যার তুলনায় গোটা পৃথিবী তুচ্ছ । তাঁদের সমূদয় বিষয় মহান আল্লাহ পাকের কাছে সোপর্দ করাই একান্ত কর্তব্য । কারণ আল্লাহ পাক তাঁদের সকল প্রয়োজন পূরণে সক্ষম ।
“তাঁর নিয়ামত আছে রাশি রাশি
যাকে তিনি দিবেন খুঁশি”।
তাই বেশি বেশি হাদিয়া পাওয়ার আশায় বা মার্কেট পাওয়ার আশায় কিংবা পরের বছর আহুত হওয়ার আশায় এরকম নিন্দনীয় কাজ থেকে বিরত থাকা ঈমানী দায়িত্ব বলে মনে করি ।
মসজিদ কমিটির করণীয় হলো, হাফিজ ছাহেব ঠিক করার পূর্বেই তাঁদের সাথে এ মর্মে শর্ত করা জরুরী, যাতে করে তাঁরা এভাবে কোরআন কারীম কে বিগড়িয়ে পড়ে সকলকে গুনাহগার না করেন । বরং সহীহ ভাবে হদরের নিয়মে কোরআন তিলাওয়াত করেন । যাতে তিনিও সাওয়াবের ভাগি হন এবং অন্যদেরকেও সাওয়াবের ভাগিদার হওয়ার সহজ সুযোগ তৈরি করে দেন ।
আল্লাহ পাক সকলকে জানা ও মানার তাওফিক দিন ।
[বিঃদ্রঃ সম্মানিত হাফিজ ছাহেব গণের নিকট বিনীত অনুরোধ, এই পোস্টটি পাওয়ার পর আমার প্রতি ক্ষিপ্ত না হয়ে আপনাদেরই একান্ত হিতাকাঙ্ক্ষী মনে করে দু’আতে শামিল করবেন । আমি সম্পূর্ণ ‘الدين النصيحة’ হিসেবে আল্লাহর ওয়াস্তে এই লেখাটি পোস্ট করেছি মাত্র । আল্লাহ পাক আমাকে ও সকলকে ক্ষমা করুন ও আমল করার তাওফিক দিন । আমীন]
তথ্য সুত্রঃ
সুরা মুজ্জাম্মিল- আয়াতঃ ০৪
তিরমিযি শরীফ- ২ঃ১১৯-১২১
নাসায়ী শরীফ- ১ঃ১১৬
মিশকাত শরীফ- ১ঃ১১৪
ফাতাওয়ায়ে রাহমানিয়া- ১ঃ৪৬৩ প্রভৃতি