দৃক নিউজ২৪, ডেস্ক:- হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকায় তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমাতে কম সুদে সরকারকে ঋণ দিয়েছিল ব্যাংকগুলো। কিন্তু এখন চাহিদা বেড়ে যাওয়া এবং নগদ অর্থের টান পড়ায় সুদ হার বেড়ে গেছে। এতে সরকারের ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের হাতে থাকা ট্রেজারি বন্ডের পুনর্মূল্যায়ন করতে গিয়ে লোকসানের মুখে পড়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। অনেকেই বন্ডের পুনর্মূল্যায়নজনিত ক্ষতিতে দিশেহারা। এমনি পরিস্থিতিতে লোকসান কমিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে বৈঠক বসছে ব্যাংকারদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, করোনার কারণে গত প্রায় দেড় বছর যাবৎ ব্যাংকে বিনিয়োগ চাহিদা কমে গেছে। আবার এ সময় রেমিট্যান্সের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো যে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করত তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে স্থানীয় টাকা নিয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় ঋণ দিয়ে পুনঃঅর্থায়নের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকে নগদ টাকা প্রবেশ করেছে। সব মিলিয়ে টাকার প্রবাহ বেড়ে গিয়েছিল। বিনিয়োগ চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে প্রতিটি ব্যাংকের হাতেই উদ্বৃত্ত নগদ অর্থ ছিল। বছরের শুরুতে ব্যাংকিং খাতে উদ্বৃত্ত অর্থ ছিল ২ লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমাতে সরকারকে ঋণ দিতে লাইন ধরেছিল। তারা কম সুদে তখন ঋণ দেয়। এভাবে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের এক সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে ৭৮ হাজার ৪৬০ কোটি টাকার বন্ড কেনা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, টাকার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে সুদহার বেড়ে গেছে। একই সাথে বেড়েছে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহার। যেমন, গত ৫ আগস্টে ২ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদহার ছিল ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ, দুই মাসের ব্যবধানে গত ২ নভেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। আবার গত ১১ জুলাই ৫ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদহার ছিল ৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ, সেখানে গত ৯ নভেম্বর ৫ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদহার বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এ দিকে ২৩ জুনে ৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ সুদে সরকারকে ১০ বছর মেয়াদি বন্ডের ঋণের জোগান দেয়া হয়। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার ১০ বছর মেয়াদি বন্ডে সরকারকে ঋণের জোগান দেয়া হয়েছে ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আবার মাত্র ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ সুদে গত ২৮ মার্চ ১৫ বছর মেয়াদি বন্ডে ঋণের জোগান দেয়া হয়। গত ২৬ অক্টোবর একই বন্ডে ব্যাংকগুলো ৭ দশমিক ১৯ শতাংশ সুদে সরকারকে ঋণের জোগান দেয়। একইভাবে ২৮ জুলাই ৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ সুদে ২০ বছর মেয়াদি বন্ডে ঋণ নেয়। কিন্তু গত ২৬ অক্টোবর একই বন্ডে ঋণ দিতে ব্যাংকগুলো সুদ নিয়েছে ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
বন্ডের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় যারা আগে কম সুদে বিনিয়োগ করেছিল তারা পড়ে গেছে বেকায়দায়। কারণ, ব্যাংকগুলোকে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করার সময় ঘোষণা দিতে হয়, ধারণকৃত ট্রেজারি বিল ও বন্ড দিয়ে এসএলআর সংরক্ষণ খাতে (এইচটিএম) সংরক্ষণ করবে না ট্রেডিং খাতে (এইচএফটি) সংরক্ষণ করবে। এইচটিএম (হেল্ড টু ম্যাচুরিটি) বিনিয়োগকরা ট্রেজারি বিল ও বন্ড মেয়াদ পূর্তি পর্যন্ত ধরে রাখতে হয়। এর জন্য বাজার অনুযায়ী পুনর্মূল্যায়ন হয় না। অর্থাৎ ট্রেজারি বিল বন্ডের সুদহার বাড়লে কোনো লোকসান গুনতে হয় না ব্যাংকগুলোর। আর এইচএফটি হলো (হেল্ড ফর ট্রেডিং) মেয়াদ পূর্তির আগে যেকোনো সময় ব্যাংকগুলো তা বিনিময় করতে পারে। এ কারণে মার্ক টু মার্ক ভিত্তিতে তা পুনর্মূল্যায়ন হয়। অর্থাৎ সুদহার বেড়ে গেলে ব্যাংকগুলোর লোকসান গুনতে হয়, আর সুদহার কমে গেলে মুনাফা বাড়ে যা ব্যাংকগুলোর রিজার্ভে সংরক্ষিত হয়। আর কেউ বিক্রি করলে তা সরাসরি ব্যাংকগুলোর আয় খাতে চলে যায়। যেমন, একটি ব্যাংক ৫ শতাংশ সুদে সরকারের ১০ বছর মেয়াদি বন্ডে বিনিয়োগ করল। কিন্তু কিছু দিন পর সুদহার বেড়ে ৮ শতাংশ হলো।
তখন পুনর্মূল্যায়ন করলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে লোকসান গুনতে হবে। কারণ, ১০৫ টাকার বন্ড যখন ১০৮ টাকা হয়, তখন সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে ৩ টাকা লোকসান দিয়ে বন্ড বিক্রি করতে হয়। আর এ পুনর্মূল্যায়ন করা হয় প্রতি সপ্তাহের বাজার দরের ভিত্তিতে। এভাবেই ব্যাংকগুলো লোকসানের মুখে পড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, লেনদেন হয় এমন বন্ডের (এইচএফটি) মূল্য প্রতি সপ্তাহেই পুনর্মূল্যায়ন হয়। সুদহার বেড়ে যাওয়ায় পুনর্মূল্যায়নজনিত কারণে বেশির ভাগ ব্যাংক লোকসানের মুখে পড়ে যাচ্ছে। এতে বছর শেষে বেশির ভাগ ব্যাংকেরই নিট মুনাফা কমে যাচ্ছে। এ লোকসান কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে আজ বুধবার বৈঠক বসছে পিডি ব্যাংকগুলো। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের নেত্বত্বে ৭ সদস্যের এক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ডেপুটি গভর্নরের সাথে বৈঠক করবেন। বৈঠকে জনতা, অগ্রণী, এনসিসি, মার্কেন্টাইল ব্যাংক এবং নতুন প্রজন্মের মিডল্যান্ড ব্যাংকের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, কম সুদে ঋণ দিয়ে এখন পুনর্মূল্যায়নজনিত কারণে প্রতি সপ্তাহেই তারা বিপুল অঙ্কের লোকসান গুনছেন। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ব্যাংকগুলো পড়েছে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায়। তুলনামূলক আমানত কম হওয়ায় তাদের বাধ্যতামূলক তরল সম্পদ (এসএলআর) সংরক্ষণ করতে হয় কম পরিমাণ। কিন্তু তাদের কাছে সরকারি ট্রেজারি বন্ড রয়েছে বেশি। এ কারণে তারা প্রতি সপ্তাহেই মার্ক টু মার্ক ভিত্তিতে পুনর্মূল্যায়নজনিত কারণে বিপুল অঙ্কের লোকসান গুনছেন।
প্রসঙ্গত, ব্যাংকগুলোর লোকসান কমাতে এইচটিএম অংশে ধারণকৃত ব্যাংকগুলোর গত এক বছরে বিনিয়োগ করা সরকারি বিভিন্ন বন্ডের সীমা ১২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৭৫ শতাংশ পুনর্নিধারণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক সার্কুলার লেটারের মাধ্যমে ১২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৩৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। আজকের বৈঠকে ১৭৫ শতাংশ পুনর্নির্ধারণ করতে দাবি জানানো হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের দাবি বিবেচনায় নিলে লোকসানের পরিমাণ কমবে।
More News Of This Category