তাসিন নূর রাহিম, যুক্তরাষ্ট্র:- উনবিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক। গৃহযুদ্ধের উত্তাপে পুড়ে ভাগ হয়ে গেছে আমেরিকা। আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য নিজের দেশটাও যেন হয়ে উঠেছে নরক। দাসপ্রথার কারণে যদিও তাদের নিজস্ব বলে তেমন কিছু ছিল না। কিন্তু সেসবও যেন বাঁধ ভেঙেছে সেবার। কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের এই দুর্বিষহ জীবনে বলার মতো কিছুই বাকি ছিল না। অবহেলিত, নিষ্পেষিত আর অতিসাধারণ এই জীবনে গর্ব করার মতো বিশেষ কিছু থাকবার কথাও নয়। কিন্তু, একটা বিষয় নিয়ে তারা ঠিকই গর্ব করত। জন হেনরি! জন হেনরির মতো শক্তিশালী মানুষ আর দুটো ছিল না সেসময়। কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনের তাই একটা বড় অহংকারের জায়গা ছিলেন জন উইলিয়াম হেনরি নামের মানুষটি। যার কিংবদন্তি পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিল পৃথিবীব্যাপী কৃষ্ণাঙ্গদের অনুপ্রেরণার মন্ত্র।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৮৬১-৬৫ খ্রিস্টাব্দে;
সময়টা ১৮৬৩-৬৪। আমেরিকান গৃহযুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ রণাঙ্গন তখন প্রিন্স জর্জ কাউন্টি। ইউনিয়ন বাহিনীর কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধারা মিলিত হন শহরের সিটি পয়েন্টে। মাত্র চল্লিশ মাইল দূরের পিটসবার্গ তখনও কনফেডারেট বাহিনীর দখলে। দু’বছর আগে থেকেই ইউনিয়ন বাহিনী ব্যাপক চেষ্টা চালাচ্ছে কনফেডারেটদের দুর্গ ভেঙে দিতে। কিন্তু, কোনোভাবেই সফল হচ্ছিল না। শেষবারের মরণকামড় আর ঠেকাতে পারেনি কনফেডারেটরা। ভেঙে পড়ে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ। ইউনিয়ন বাহিনী দখল করে নেয় পিটসবার্গ। তবে, এই যুদ্ধে মারা যায় উভয়পক্ষের প্রায় ২০ হাজার সৈন্য। এসব যোদ্ধার জায়গা হয় প্রিন্স জর্জ কাউন্টির বিভিন্ন জলাশয়ে।
তবে, যুদ্ধরত দু’পক্ষের কাজে না লাগলেও, এই মৃতদেহ সার কারখানার মালিকদের জন্য ছিল বেশ কাজের জিনিস। মৃতদেহের হাড় থেকে সার উৎপাদনের উদ্দেশ্যে সেসময় এসব জলাশয় থেকে মৃতদেহ উত্তোলন করতে থাকেন কারখানা মালিকরা। জন উইলিয়াম হেনরি ছিলেন এই মৃতদেহ তোলার শ্রমিকদের একজন। দিনে মৃতদেহ উদ্ধার আর রাতে বাড়ি ফেরা— এই ছিল তার সেসময়কার দৈনন্দিন রুটিন। এরই মধ্যে জীবনের মোড় ঘুরে যায় হেনরির। গৃহযুদ্ধের ফলে আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে যে বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল তা নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন কিছু আইন তৈরি করা হয়। এই আইনের আওতায় বিনা কারণে কেউ শহরে ঘোরাঘুরি করলেও ভবঘুরে হিসেবে শাস্তি দেওয়া হতো। আপাতদৃষ্টিতে বেশ যুক্তিযুক্ত আর বর্ণ নিরপেক্ষ আইন।
কিন্তু, কিছুদিন পরেই দেখা গেল— আসামি হিসেবে যাদের কোর্টে তোলা হচ্ছে তাদের সবাই কৃষ্ণাঙ্গ! পরবর্তীতে বিশ্লেষকরা একে ‘ব্ল্যাক কোড’ নামে অভিহিত করে। সেসময় বহু কৃষ্ণাঙ্গকে এই আইনের কবলে জেলে পুরে দেওয়া হয়। জন হেনরি ছিলেন সেই আসামিদের একজন। তবে, গ্রেফতারের পর কোর্টে উঠে তার আক্কেল গুড়ুম। ভবঘুরে আইনে নয়, তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে ডাকাতির ঘটনায়! ওয়াইজম্যান’স গ্রোসারি নামের এক মুদি দোকানে চুরির ঘটনায় তাকে আটক করা হয়। বলে রাখা ভাল, সেসময় এসব মামলার ভবিষ্যত নির্ভর করত দায়িত্বরত অফিসারের উপর। কিন্তু, হেনরির অদৃষ্টকে খারাপই বলতে হয়। কারণ, তার মামলার দায়িত্বে থাকা অফিসার চার্লস বার্ড ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী একজন ব্যক্তি। ‘বর্বর’ আর ‘উশৃঙ্খল’ কৃষ্ণাঙ্গদের সোজা করাই ছিল কাজ! তবে, পোক্ত অভিযোগ ছিল না হেনরির বিপক্ষে। সেসময় কমপক্ষে ২০ ডলার খোয়া না গেলে সেটাকে ডাকাতির আওতায় ফেলা যায় না। কিন্তু, সেই দোকানের মোট সম্পত্তির মূল্যই ছিল মাত্র ৫০ ডলার! ফলে, হেনরির বিরুদ্ধে অভিযোগ পাকা করতে বিপক্ষের উকিল মুদির দোকানকে বসতবাড়ি হিসেবে উল্লেখ করেন। আর এই বসতবাড়িতে ডাকাতির মতো গুরুতর অভিযোগেই দশ বছর কারাবাসের শাস্তি দেওয়া হয় হেনরিকে। কিন্তু, সেসময় নিজেদের উপর এই অনধিকার চর্চার বিরুদ্ধে কিছুই বলার ছিল না আমেরিকার হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গের। ছিল না হেনরিরও। অগত্যা তাকে কারাবাস বরণ করে নিতে হয়। হেনরির ঠাঁই হয় ভার্জিনিয়ার কারাগারে।
গ্যাসোলিন যুগের আগে রেললাইন নির্মাণের জন্য প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হতো। আমেরিকার অর্থনীতিতে রেলের যে ব্যাপক প্রসার প্রয়োজন তার যোগান দিতেই পাহাড় কেটে, টানেল বানিয়ে তৈরি করতে হতো বাষ্পইঞ্জিন চলার পথ। এই ব্যাপক কর্মযজ্ঞে শামিল করা হতো কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের। সেসময় কারাগারগুলোতে চলত অদ্ভুত এক নিয়ম। শাস্তিপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গ আসামিদের কারাগার কর্তৃপক্ষ দৈনিক ২৫ সেন্ট মজুরির বিনিময়ে ভাড়া দিত এসব রেলপথ নির্মাণের কাজে।
১৮৭০-এ সুড়ঙ্গ খনন করা ছিল খুবই দুরূহ এবং ধীরগতির কাজ; Image Source: National Park Service
ভার্জিনিয়ার কারাগারে থাকা অন্য কয়েদিদের সাথে জন হেনরিও রেলপথ নির্মাণের শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন C&O (Chesapeake & Ohio) কোম্পানিতে। তাদের কাজ পাহাড় কেটে টানেল বানানো। একটা হ্যান্ড ড্রিল পাহাড়ের গায়ে ঢুকিয়ে সেটাকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে পাহাড় কাটতে হতো। এটা ছিল অমানুষিক পরিশ্রমের কাজ। কিন্তু, হেনরি সেই কাজ করতেন একেবারে হেসেখেলে। এ যেন তার কাছে কোনো কাজই নয়। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন সবার মাঝে। দীর্ঘদেহী, ইস্পাততুল্য পেশির অধিকারী হেনরি যখন গলা ছেড়ে পাহাড় কাটতেন, তখন তার কণ্ঠ যেন উজ্জীবিত করত তার সঙ্গীদের। এমন শক্তিশালী মানুষ যে তাদেরই একজন— এটা ভেবেই গর্ব হতো তাদের। শ্বেতাঙ্গদের সব অত্যাচারের ক্ষোভ যেন তারা ঝারত তাদের হাতে থাকা হ্যান্ড ড্রিলকে পিটিয়ে!
এর মধ্যেই একদিন কোম্পানির পক্ষ থেকে স্টিম ড্রিল নামের একধরনের পাহাড় কাটার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র কেনার প্রস্তাব করা হলো। এই যন্ত্র ব্যবহার করে পাহাড় কাটা সহজ। আর যেহেতু পাহাড় কাটার মেশিন পাওয়া গেছে তাই অচিরেই শ্রমিকদের জানিয়ে দেওয়া হলো, এত লোক প্রয়োজন হবে না তাদের। মুহূর্তে আকাশ ভেঙে পড়ল সাধারণ শ্রমিকদের মাথায়। চাকরি হারানোর শঙ্কায় মাথার উপর নেমে এলো ঘোর অন্ধকার! কিন্তু, হেনরি প্রতিবাদ করলেন কোম্পানির এই সিদ্ধান্তের। কোম্পানির কর্তাদের সামনে তিনি বলে বসলেন- এই মেশিন হারাতে পারবে না তাকে! মেশিনের থেকেও দ্রুত, আর বেশি কাজ করতে পারবেন তিনি। হেনরির কথা আর সাহস দেখে কোম্পানির বড় কর্তাদের আক্কেল গুড়ুম। তারাও উল্টো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন হেনরিকে; যদি তিনি এই যন্ত্রকে হারাতে পারেন, তবে চাকরি যাবে না কারও!
যন্ত্রের সাথে লড়াইয়ে হেনরি জিততে পারলে তবে মেনে নেয়া হবে দাবি
অবশেষে, এলো সেই দিন। ভার্জিনিয়ার বিগ বেন্ড টানেলে পাহাড় কাটার প্রতিযোগিতা শুরু হলো। বামপাশে মেশিন আর ডানপাশে হেনরি। শুরু হলো মানুষ আর যন্ত্রের অসম লড়াই। এ লড়াই গভীর থেকে গভীরে যাওয়ার। ৬ ফুট উচ্চতা আর ২০০ পাউন্ড ওজনের বিশালদেহী হেনরি তার হাতে থাকা ৯ পাউন্ড ওজনের হাতুড়ি আর হ্যান্ড ড্রিল দিয়ে লড়তে থাকলেন জীবনের সবচেয়ে বড় লড়াই। এ লড়াই তো শুধু তার নয়। এ লড়াই যন্ত্র বনাম মানুষের, এ লড়াই শ্বেতাঙ্গ বনাম কৃষ্ণাঙ্গের, এ লড়াই শোষিত বনাম শোষকের!
সর্বশক্তি দিয়ে হেনরি চালিয়ে গেলেন লড়াই। অবশেষে বেলা পড়ে এলো। ফলাফলের পালা। দেখা গেলো- হেনরি পাহাড় কেটে এগিয়েছেন ১৪ ফুট। আর মেশিন সারা দিনে কাটতে পেরেছে মাত্র সাড়ে ৯ ফুট পাহাড়! টানেলের মধ্য থেকে উল্লাসধ্বনি ভেসে আসলো। ভেসে আসলো হেনরির জয়গান। পরমুহূর্তেই হাত থেকে হাতুড়ি পড়ে গেল হেনরির। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল তার অবসন্ন দেহও। যন্ত্রের সাথে যুদ্ধে তিনি জিতলেন বটে, কিন্তু ক্লান্তির কাছে হার মানতে হলো তাকে। অকল্পনীয় পরিশ্রমে ভেঙে পড়া শরীর নিয়ে মারা গেলেন জন উইলিয়াম হেনরি। কৃষ্ণাঙ্গ আর শোষিত শ্রেণীর জন্য রেখে গেলেন গর্ব করার মতো এক গল্প!
জেদের লড়াইয়ে জিতে গেলেও হেনরি হেরে যান জীবনের কাছে;
বিংশ শতক পর্যন্ত জন হেনরির এই কিংবদন্তিকে লোককথাই মনে করা হতো। কিন্তু, পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে, জন হেনরি শুধুমাত্র লোককথার চরিত্র ছিলেন না। কলেজ অব উইলিয়াম এন্ড মেরির ইতিহাসের অধ্যাপক স্কট রেনল্ডস নেলসন হেনরির লোককথার উপর একটি গবেষণাধর্মী বই লেখেন, যাতে তিনি প্রমাণ করেছেন, জন উইলিয়াম হেনরি নামের একজন সত্যিই ছিলেন, যিনি সেসময় কারাগারে বন্দি অবস্থায় সি এন্ড ও কোম্পানির শ্রমিক হিসেবে রেললাইন বানানোর কাজ করতেন। তবে, হেনরির শারীরিক বর্ণনা আর যন্ত্র বনাম মানুষ লড়াই নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি। তাতে কিছু যায়-আসে না অবশ্য। তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের কাছে প্রবাদতুল্য পুরুষ। তার কীর্তি নিয়ে লেখা হয়েছে অসংখ্য ব্যালাড।
হেনরিকে নিয়ে লেখা এসব গানের রেকর্ডেড ভার্সনের সংখ্যাই দুই শতাধিক। আমেরিকায় প্রথম রেকর্ডেড কান্ট্রি সংও হেনরিকে নিয়ে লেখা। লোকসাহিত্য গবেষকদের মতে- এটি আমেরিকার সবচেয়ে বেশি গবেষণাকৃত গান। শুধু আমেরিকা নয়, হেনরির এই ব্যাল্যাড নিয়ে পুরো পৃথিবীতে যে পরিমাণ গবেষণা হয়েছে তা নজিরবিহীন। ফলত, জন হেনরি আদতে বাস্তবিক চরিত্র ছিলেন নাকি কাল্পনিক- সেই প্রশ্নও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর যেকোনো স্থানেই শোষিত-বঞ্চিত শ্রেণীর আন্দোলন-বিপ্লবে, বিপ্লবীদের সাথী হয়েছে জন হেনরির হাতুড়ি। যার আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সব অন্যায়, শোষণ আর অবিচার।
More News Of This Category