মাওঃ মুফতি মোঃ আবু সাঈদ সৈয়দ:-
নারী-পুরুষ। একে অপরের পরিপূরক। জীবনের প্রতিটি স্তরে ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। ইসলাম নারীকে দিয়েছে মহা সম্মান ও মর্যাদা। মেয়ে সন্তানের সুষ্ঠু লালন-পালনকে জান্নাতে যাওয়ার অনন্য মাধ্যম বলা হয়েছে। রাসুল সা. বলেন, ‘যার তিনটি মেয়ে আছে অথবা তিনজন বোন আছে কিংবা দুই বোন বা দুই মেয়ে আছে, অতঃপর সে তাদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করে, উত্তম পাত্র দেখে বিয়ে দেয় এবং তাদের সঙ্গে সর্বোত্তম ব্যবহার করে। তার জন্য জান্নাত অবধারিত।’ [সুনানে তিরমিজি]
ইসলামে নারীর জন্য পরিষ্কার ভাষায় পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করেছে। পুরুষ এবং নারী উভয়েই পৈতৃক সম্পত্তির ন্যায্য অংশ লাভ করবে। এ ক্ষেত্রে সমাজে কিছু কুসংস্কার দেখা যায়। আমাদের দেশের মেয়েরা বা বোনেরা বাবার বাড়ির সম্পত্তি আনেন না। এটা ভেবে যে, বাবার বাড়ির সম্পত্তি আনলে তারা গরিব হয়ে যাবেন! বাবার বাড়ির সম্পত্তি আনলে ভাইদের কাছে দাঁড়ানোর অধিকার তাদের থাকবে না। বাবার বাড়ির সম্পত্তি নিলে যেন সে পর হয়ে যায়।
তিক্ত সত্য হলো, অনেক এলাকায় দেখা যায় বোন বা ফুফুরা যদি তাদের উত্তরাধিকারী সম্পত্তি নিয়ে যায়- তাহলে তাদের বাবার বাড়ি আসা, বেড়ানোর অধিকার থাকে না। এটা ঠিক নয়। ইসলাম একে সমর্থন করে না। কারণ, সম্পত্তির অংশ নেওয়া বোনের স্বতন্ত্র অধিকার।
পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের সন্তানের বিষয়ে আদেশ দিচ্ছেন। (তোমাদের রেখে যাওয়া সম্পদে) এক ছেলের অংশ দুই মেয়ের অংশের সমান। আর যদি সন্তান শুধুই মেয়ে হয়, তাহলে তারা একাধিক হলে পুরো সম্পদের দুই-তৃতীয়াংশ পাবে। যদি এক মেয়ে থাকে, তাহলে সে পাবে পূর্ণ সম্পদের অর্ধেক…।’ [সূরা নিসা, আয়াত : ১১]
পবিত্র কুরআনে কন্যাদেরকে অংশ দেয়ার প্রতি এতটুকু গুরুত্ব আরোপ করেছে যে, কন্যাদের অংশকে আসল ভিত্তি সাব্যস্ত করে এর অনুপাতে পুত্রদের অংশ ব্যক্ত করেছে। অর্থাৎ ‘দুই কন্যার অংশ এক পুত্রের অংশের সমপরিমাণ’ বলার পরিবর্তে ‘এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমপরিমাণ’ বলে ব্যক্ত করা হয়েছে। অনেকেই বোনদেরকে অংশ দেয় না এবং বোনেরা এ কথা চিন্তা করে অনিচ্ছাসত্ত্বেও চক্ষুলজ্জার খাতিরে ক্ষমা করে দেয় যে, পাওয়া যখন যাবেই না, তখন ভাইদের সাথে মন কষাকষির দরকার কি। এরূপ ক্ষমা শরীয়তের আইনে ক্ষমাই নয়; ভাইদের জিম্মায় তাদের উত্তরাধিকারী সম্পত্তি পাওনা থেকে যায়। যারা এভাবে ওয়ারিশীর অংশ আত্মসাৎ করে, তারা কঠোর গোনাহগার। এরপর আরো ব্যাখ্যা সহকারে কন্যাদের অংশ বর্ণনা করে বলা হয়েছে যে, যদি পুত্র সন্তান না থাকে, শুধু একাধিক কন্যাই থাকে, তবে তারা পরিত্যক্ত সম্পত্তির তিন ভাগের দুই ভাগ পাবে। এতে সব কন্যাই সমান অংশীদার হবে। অবশিষ্ট তিন ভাগের এক ভাগ অন্যান্য ওয়ারিশ যেমন মৃত ব্যক্তির পিতা-মাতা, স্ত্রী অথবা স্বামী প্রমূখ পাবে। কন্যাদের সংখ্যা দুই বা তার বেশী হলে দুই-তৃতীয়াংশের মধ্যে তারা সমান অংশীদার হবে।
বোনের সম্পত্তিকে মহান আল্লাহর নির্ধারিত সীমা আখ্যা দেয়া হয়েছে এবং সুষ্ঠুভাবে বুঝিয়ে দেয়াকে জান্নাতে যাওয়ার মাধ্যম বলা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এসব আল্লাহর নির্ধারিত সীমা এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের অনুসরণ করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, তারা তাতে চিরবাসী হবে এবং এটা বিরাট সাফল্য।’ [সূরা নিসা, আয়াত : ১৩]
আর যারা বোনের সম্পত্তি বুঝিয়ে দেয় না তাদেরকে জাহান্নামের অপমানজনক শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নাফরমানী করে এবং তাঁর সীমারেখা লঙ্ঘন করে আল্লাহ তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে স্থায়ী হবে। আর তার জন্যই রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।’ [সূরা নিসা, আয়াত : ১৪]
আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা তথা ওয়ারিশী নীতির ব্যাপারে যে বিধান দেয়া হয়েছে তা লঙ্ঘন করবে তার জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। কেননা সে আল্লাহর হুকুমকে পরিবর্তন করেছে, আল্লাহর বিধানের বিরোধিতা করেছে। তখনই কেউ এরূপ করতে পারে যখন সে আল্লাহর নির্দেশের উপর অসন্তুষ্ট থাকে। এজন্য আল্লাহ তাকে চিরস্থায়ী লাঞ্ছনা দ্বারা শাস্তি দিবেন।
ভাইয়ের সঙ্গে বোনের যে রক্তের সম্পর্ক তা উত্তরাধিকারী সম্পত্তি নিলেও থাকবে, না নিলেও থাকবে। বাবার সম্পত্তি যদি বোন নিয়ে যায় তার পরেও ভাইয়ের কর্তব্য হলো; বোনের দেখা-শোনা করা, খোঁজ-খবর নেওয়া। বোন যদি তার উত্তরাধিকারী সম্পত্তি না নেয় তারপরেও ভাইয়ের কর্তব্য হলো, তার বোন কি কুসংস্কারের কারণে বা তার খোঁজখবর নেওয়া হবে না এ কারণে সম্পত্তি নিচ্ছে না! এটা জানা।
যদি এটাই হয় তাহলে বোনকে বোঝাতে হবে, ভাই হিসেবে তোমার প্রতি আমার যে দায়িত্ব এর ব্যত্যয় ঘটবে না। অতএব তুমি নির্ধিদ্বায় সম্পত্তি নিতে পার। এভাবে বলার পরও যদি বোন বাবার বাড়ির সম্পত্তি না নেয় তাহলে এটা ভাইয়ের জন্য ভোগ করা জায়েজ। ভিন্ন কোনো কারণে হলে জায়েয হবে না।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের সমাজে ভাইয়েরা ছলেবলে-কৌশলে বোনদের প্রাপ্য থেকে তাদের বঞ্চিত করে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে ভাইয়ের কাছ থেকে প্রাপ্য অর্থ-সম্পদ নেওয়াকে সমাজের চোখে ‘অপরাধ’ হিসেবে দেখা হয়। অথচ রাসুল সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কারো উত্তরাধিকার সম্পত্তি গ্রাস করে, অন্য বর্ণনামতে, যে ব্যক্তি কারো উত্তরাধিকারী সম্পত্তি নিয়ে পলায়ন করে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের অংশ থেকে বঞ্চিত করবেন।’ [ইবনে মাজাহ] মহান আল্লাহ আমাদেরকে বোনদের সম্পত্তি সুষ্ঠুভাবে বুঝিয়ে দেয়ার তাওফিক দান করুন।
আমিন।
লেখক:- সুপার
হাতিয়া, নাচনী,বেতাউকা পীর আকিল শাহ নেছারিয়া হাফিজিয়া দাখিল মাদরাসা।
দিরাই, সুনামগঞ্জ।
সিলেট।