ফারুক ওয়াসিফ:– সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ভাতিজি বুলবুলিকে জড়িয়ে মূর্ছা যান চাচা শারফুল মিয়া। গতকাল ময়মনসিংহের ফুলপুরে ঘটনাস্থলে।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ভাতিজি বুলবুলিকে জড়িয়ে মূর্ছা যান চাচা শারফুল মিয়া।
মরার দেশে জীবন জিয়ে না। আরও একটি পরিবার শেষ হয়ে গেল। ফিলিস্তিনে বাড়িতে বোমা পড়লে একসঙ্গে সবাই মারা যায়, সিরিয়ার যুদ্ধে, আফগানিস্তান-ইরাকে নাশকতার ঘটনাগুলো এভাবে পরিবারসুদ্ধ প্রাণ নেয়। বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধ চলছে না। কিন্তু কত পরিবার কতভাবে যে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তেমনি করে শেষ হয়ে গেল বুলবুলি নামের মেয়েটির পরিবার। সেই ছবিগুলো দেখা যায় না। মাটিতে শুয়ে আছে এক পুরুষ, বুকে আঁকড়ে থাকা এক শিশু। ভাতিজিকে বুকে জড়িয়ে শোকে অজ্ঞান হয়ে গেছেন চাচা, বাবা পাগলপারা হয়ে শুধু বলছেন, ‘বুলবুলিরে, তুই আর উড়বি না! আর আব্বা ডাকবি না?’ পপসম্রাট আজম খান থাকলে হয়তো আবারও চিৎকার করে বলতেন, ‘শিশুটি মরে গেছে, হায় আমার বাংলাদেশ!’
খোদা তাআলা মানুষের বুকে সন্তান দেন মানুষকে মানবিক রাখার জন্য। শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে ভালো লাগে, বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে, শিশুর কাছে সৎ ও সুন্দর থাকতে ইচ্ছা করে পিতা–মাতার। ভাইবোনের ভালোবাসা জীবনের ভরসা। দুনিয়া যত দুঃখই দিক, শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে সান্ত্বনা আসে। আজকের দুনিয়ার করুণ কঠিন পরিবেশে এইটুকু বেহেশতি সুবাস—এই সন্তান, এই নিষ্পাপ ফুল। কিন্তু চার ভাইবোনসহ শিশুটি মরে গেছে। মরে গেছে তাদের মা। মরে গেছে তাদের মামা-খালারাও। আহারে জীবন! এই কি জীবন?
মঙ্গলবার ময়মনসিংহের ফুলপুরে পিকআপের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়াতে গিয়ে বেসামাল হয়ে যাওয়া মাইক্রোবাস পুকুরে পড়ে মৃত্যু হয় একই পরিবারের আটজনের। পরিবারটি গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিল তাদের আরেক আত্মীয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে। পরিবারের প্রতি পরিবারের এই টান এখনো বাংলাদেশে আছে। না হলে বুলবুলির বাবা শাজাহান কেন খালাতো ভাইয়ের মৃত্যুতে পরিবার নিয়ে ছুটে যেতে চাইবেন? অথচ কিনা প্রাণের টান টেনে নিয়ে গেল পরিবারসুদ্ধ সলিলসমাধিতে?
এই আগস্ট মাসের প্রথম ১৯ দিনে কেবল প্রথম আলোতেই ৫০টি সড়কে মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই ময়মনসিংহেই কয়েক দিন আগে আরেকটি ঘটনায় সাতজন মারা গেছেন। সিলেটে এভাবে মারা গেছেন চারজন। সকল সংখ্যার মধ্যেই এক বা একাধিক শিশু রয়েছে। সংখ্যাগুলো একসময় জীবন ছিল। খরচযোগ্য জীবন, অপচয়যোগ্য জীবন।
খবর সব সময় সত্য বলে না। সাংবাদিকের উপায় নেই বলা যে সড়ক দুর্ঘটনা আসলে কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। যে হরিলুটের কারখানা হয়েছে দেশ, সেই দেশের সড়কে কোনো নিরাপত্তা নেই। কিছুই ঠিকঠাক চলে না সেখানে। কয়েক দিন আগে পর্বতজয়ী রত্না নামের এক তরুণী সংসদ ভবনের পেছনের রাস্তায় মারা গেলেন। তিনি চালাচ্ছিলেন সাইকেল, একটা গাড়ি এসে তাঁকে মেরে দিয়ে যায়। কত ফুল ফোটে আর এভাবে রাস্তায় ঝরে যায়, তার হিসাব রাখতে যাওয়াও মর্মান্তিক ব্যাপার। দেশে এমন পরিবার খুব কম পাওয়া যাবে, যাদের কেউ না কেউ, যাদের কাছের কেউ না কেউ, যাদের আত্মীয়দের কেউ না কেউ সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়নি। মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যুর বিরুদ্ধে এ কোন যুদ্ধ চলছে দেশে?
ময়মনসিংহের ফুলপুর-শেরপুর সড়কে মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ে গেলে আটজন নিহত হন। পরে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় লোকজনের উদ্ধার তৎপরতা। গতকাল সকালে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বাঁশাটি গ্রামে। পরে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় লোকজনের উদ্ধার তৎপরতা। গতকাল সকালে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বাঁশাটি গ্রামে।
রত্না কিছু একটা হয়ে উঠছিলেন, আরও অনেক ওপরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল তাঁর। কিংবা যে ভাইবোনসহ বুলবুলিরা মারা গেল, এই ছেলেমেয়েদের সামনেও তো পড়ে ছিল সম্ভাবনার ভবিষ্যৎ। এত সম্ভাবনার মৃত্যুতেও তো পরিবহন-মাফিয়া আর সড়ক-দুর্নীতির হোতাদের মসনদ টলে ওঠে না। দুই বছর আগে ঢাকার কিশোর-কিশোরীরা সড়কে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে হাজারে হাজারে পথে নেমে এল। দেশবাসীর হৃদয় আশায় উদ্বেল হয়ে উঠল। কিন্তু ঠগিতন্ত্রের যে নেতারা সড়ক ও পরিবহন খাতের আজরাইল হয়ে বসে ছিলেন, তাঁদের কিছু হলো না। সরকার নিষ্পাপ শিশুদের চোখের পানি দেখল না, দেখল মাফিয়াদের স্বার্থ। তাদের বাধায় একটা কার্যকর সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণীত হতে পারল না। যাও-বা হলো, তারও বাস্তবায়ন হলো না। এ কেমন দেশ, নাকি আশার সমাধি?
বিচার কিছু হয় বটে; তাও শুধু চালকের। যারা অপরিকল্পিত ও ভাঙাচোরা রাস্তার জন্য দায়ী, যারা যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, যারা মুনাফা বাড়াতে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে বাড়তি সময় ধরে চালকদের গাড়ি চালাতে বাধ্য করে, সেসব মালিক-মহাজনের কিছু হয় না। আমাদের যাবতীয় রাগ, ক্ষোভ, হতাশা তখন চালকদের ‘ঘাতক’ বলে শান্তি পায়। সমস্যার গোড়ায় এতই আগুন, সেখানে হাত দেওয়ার সাহস করে না কেউ।
ক্রমাগত অপঘাত, ক্রমাগত অপমৃত্যু, ক্রমাগত পরিবারের ধ্বংস দেখা এক ট্রমাটিক অভিজ্ঞতা। আঘাতে আঘাতে মানুষের মন চুপসে যায়, ভয়ংকর ট্রমায় আক্রান্ত আমরা অনেকেই। এত মানসিক আঘাত সামলানোর মতো ট্রমা সেন্টার কই?
সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলনের কিশোর বিদ্রোহীরা যে কত সঠিক ছিল, কত জরুরি ছিল তাদের পাশে থাকা, সেটা মনে করে অনুতাপ হয়। তাদের যদি দমন করা না হতো, তাদের কথা যদি সরকার শুনত, তাহলে মরার দেশে অনেক অনেক জীবন বেঁচে যেত। কিন্তু তা হয়নি। দিনের শেষে আবারও জানা গেল, মরার দেশে জীবন জিয়ে না।
লেখক:- প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
More News Of This Category